বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রে এবার জোর লড়াই। একদিকে বিজেপি-র প্রার্থী অশোক কীর্তনিয়া, অন্যদিকে, তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন শ্যামল রায়। এই কেন্দ্রে জোর লড়াই। গতবার বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূল জিতলেও, ২০১৯ লোকসভায় বিজেপির বড় লিড আছে। দুই দলেই প্রার্থীকে নিয়ে ক্ষোভ আছে। এই দুইজনের মাঝে এই কেন্দ্রে এক নির্দল প্রার্থীকে নিয়ে জোর আলোচনা। তিনি হলেন, বনগাঁ থেকে কলকাতায় গিয়ে সফলভাবে ব্যবসা করা দীনেশ দাস।
সেই নির্দল প্রার্থী দীনেশ দাসকে সাক্ষাৎকার নিল বাংলা খবর। আসুন দেখে নেওয়া যাক তিনি কী বললেন–
প্রশ্ন: হঠাৎ ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছা কেন হল আপনার
দীনেশ দাস: ইচ্ছাটা দীর্ঘদিনের, তাড়নাটা হঠাৎ। আমার বাবা বনগাঁর রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালাতেন। আমি কখনিও কখনও বাবার রিক্সার পিছনে বসে ঘুরতে যেতাম। বাবা বনগাঁর বিভিন্ন জায়গা দেখিয়ে বলত, জায়গাটা খুব সুন্দর, কিন্তু কারও এই জায়গাটা নিয়ে ভাবনা নেই। একটু সফলতা পেলেই এখান থেকে সবাই ছেড়ে পালায়, আর বনগাঁ বন আর গাঁ হয়ে থাকে। তুই যদি সফল হোস, এই জায়গাটার জন্য কিছু করিস। মিথ্য়া বলব না, কলকাতায় গিয়ে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ব্যবসা করতে গিয়ে খেয়াল ছিল না বাবার কথাটা। তবে সমাজের জন্য প্রচারের বাইরে থেকে কাজ করে যাচ্ছিলাম। যতটা সম্ভব করছিলাম মানুষের জন্য। বনগাঁয় একটা ছেলের ফোন পেয়ে ভোটে দাঁড়ানোর তাড়নাটা এসেছিল। ছেলেটা বলেছিল, দাদা তোমরা তো সফল হলেই বনগাঁ ছাড়ো। আমরা বেকাররা বেকারই থাকি। কিছু করো না আমাদের জন্য। তখনই বাবার কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল। সেদিন থেকেই ভেবেছিলাম, বনগাঁর জন্য কাজ করব, আর তার জন্য ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে হবে।
প্রশ্ন: আপনার নির্বাচনী প্রতীক কেন ডিশ টিভি অ্যান্টেনা?
দীনেশ দাস: ডিশ টিভি বা ডিটিএইচের পুরো মানে হল ডাইরেক্ট টু হোম। একেবারে সরাসরি ঘরে হাজির। আমারও স্লোগান তাই, মানুষের সমস্যা, দু:খে আনন্দে, যখনই দরকার, তখনই সরাসরি ঘরে হাজির হব। সরাসরি পরিষেবা ঘরে পৌঁছে দেবো। কোনও এজেন্ট নয়, দালাল নয়, মানুষের প্রয়োজনে মানুষ লাইন দিতে হবে না। পোঁছে যাবে সরাসরি বাড়িতে। মানুষ অনেক কষ্ট করেছে, এবার মানুষের ঘরে বসে পরিষেবা নেওয়ার সময়। তাই ডিশ টিভি অ্যান্টেনা চিহ্নে লড়ে মানুষকে বোঝানো আমি মানুষের পাশে আছি।
প্রশ্ন: নির্দল হয়ে লড়া মানে তো গোঁজ প্রার্থী বা শখে দাঁড়ানো বা বড় দল টিকিট না দিলে ক্ষোভে নির্দল হওয়া
দীনেশ দাস: এটা একেবারে ভুল কথা। বিদেশের ভোটে নির্দলদের বড় ভূমিকা থাকে। আমাদের দেশেও নির্দল হয়ে লড়ে, জিতে ভাল কাজ করার নজির আছে। তবে এটা ঠিক এখন নির্দলরা অনেক সময় বড় দলের বিক্ষুব্ধ, বা গোঁজ প্রার্থী। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের প্রমাণ। আসলে সেই নির্দল প্রার্থীরা তখনই মূল্যহীন, যখন আসে কোনও দলের কাছে আশা করে, দলের জন্য কিছু করে শুধু প্রার্থী হবে বলে। আমি কোনও দলের জন্য কিছু করিনি, কোনও কিছু আশাও করিনি। আমি মানুষের জন্য করেছি, করছি, করব। প্রশাসনিক ক্ষমতা পেলে বৃহৎ আকারে করার সুযোগ পাবো বলেই ভোটে দাঁড়ানো। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের অনেকেই বড় বড় রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপন, সরকারী বিজ্ঞাপনের স্বার্থে নির্দল প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে ছোট করে দেখায়, হাসিঠাট্টা করায়। এর পিছনে কারণ হল যাতে নির্দলরা বড় দলগুলোর স্বার্থে আঘাত করতে না পারে।
প্রশ্ন:আচ্ছা, নির্দলরা আসলে কোন দল
দীনেশ দাস: আসল নির্দল প্রার্থীরা সত্যিই নির্দল। দেখুন নির্দল প্রার্থীদের নামে বড় দলগুলো নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে। নির্দলের নামে দল বলিয়ে চালিয়ে দেওয়াটা আসলে অপরাধ। তবু চলে আসছে এসব। আমি এটা ভাঙব বলেই লড়তে নেমেছি। নির্দল হবে স্বতন্ত্র। মানুষের জন্য পার্টি, পার্টির জন্য মানুষ। অনেক ভুল ধারনা ভাঙার লড়াই আমার। অর্থের জোরে, কানেকশন কাজে লাগালে আমি অনায়াসে কোনও না কোনও দলের প্রতীকেই ভোটে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু না। আমি বেছে নিয়েছি স্বতন্ত্রতাকে। নির্বাচন কমিশন যাই বলুক, আমি নিজেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই মনে করি। আমার মনে হয় যে মানুষের স্বতন্ত্র চিন্তা আছে, আলাদা নিজস্ব কিছু করার ইচ্ছা আছে, তারা কখনই কলকাতা-দিল্লি থেকে দাদা-দিদি-দের অঙ্গুলিহেলনে চলা পার্টির ঝান্ডার তলায় দাঁড়িয়ে কমিশন বা কাটমানি বা কিছু আর্থিক সাহায্যের আশায় দিন কাটাবে না। একজন স্বতন্ত্র মানুষ ভাবে সতন্ত্র, কাজ করে স্বতন্ত্রভাবে। তাহলে ভোটে কেন স্বতন্ত্র হয়ে লড়বে না? কেন একজন সামাজিকভাবে সফল মানুষকে তার এলাকার জন্য কাজ করতে কোনও পার্টির হয়ে লড়তে হবে?
প্রশ্ন:আপনি নিজে কখনও নির্দলকে ভোটে দিয়েছেন
দীনেশ দাস: দেখুন ভোট হল গোপন অধিকার। আমি কাকে ভোট দিয়েছি, সেটা সবাইকে বলার প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, আপনার প্রশ্নটা বেশ প্রাসঙ্গিক। যেহেতু আমি নির্দল প্রার্থী, তাই নির্দলকে ভোট দিয়েছি কি না? না, আমি কখনও নির্দলকে ভোট দিইনি। কারণ আমাদের এখানে কোনও নির্দল আসলে নির্দল ছিলেন না। আর যারা হয়তো ছিলেন, তাদের কথা জানতে পারেনি, বা কোনও ভিশন দেখিনি। আমি নির্দলদের কখনও ভোট না দেওয়ার কারণেই নির্দল হয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। কারণ আমি জানি, নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়াতে গেলে মানুষের কাছে নিজের মিশন-ভিশন তুলে ধরতে হয়। বড় দলের প্রার্থীর চেয়েও নির্দল প্রার্থীর দায়িত্ব বেশি। মানুষের কাছে নিজের ভিশন তুলে ধরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন:নোটা-য় ভোট না দিয়ে আপনাকে কেন মানুষ ভোট দেবে
দীনেশ দাস: নোটা মানে হল ‘নান অফ দ্য অ্যাবোব’ (NOTA)। কোনও প্রার্থীকে পছন্দ না হলে নোটায় ভোট দেন ভোটাররা। আমার মনে হয় আমার মিশন আর ভিশন শুনলে নোটার প্রয়োজন পড়বে না। আসলে কী জানেন নোটা হল একজন ভোটারের চিন্তার নেগেটিভ বিকল্প। আর একজন প্রকৃত নির্দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ভোটারদের পজেটিভ বিকল্প। নোটা বা নির্দলদের মানুষ তখনই ভোট দেয় যখন ভোটারের তথাকথিত বড় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ওপর কোনও আস্থা থাকে না, মনে করে এরা সবাই এক। সেখানেই বলব, নোটা মানে হল ‘না’, আর প্রকৃত নির্দল প্রার্থী হল ‘হ্যাঁ’। নোটা মানে হতাশা, প্রকৃত নির্দল প্রার্থী মানে আশা। নোটা মানে আমার আর আশা নেই, প্রকৃত নির্দল প্রার্থী মানে দেখি না সবাই দলবাজ,ইনি কী করেন। ইউরোপের কোনও এক দেশে এক নির্দল প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। সব বড় বড় দলের বড় বড় নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি জিতেছিলেন, এবং অসাধারণ কাজ করেছিলেন। ভাবুন তো, সেই প্রার্থীর কেন্দ্রে যদি নোটা থাকত, আর সবাই যদি না-কে বাছত?
প্রশ্ন: ভোটের ফল বেরোনের পর যদি এমন অবস্থা আসে যেখানে তৃণমূল, বিজেপি একেবারে সমান সমান আসন। আর সরকার গড়তে লাগবে একজন বিধায়কের সমর্থন। মানে ধরা যাক আপনি ভোটে জিতলেন,আপনার ওপরেই রাজ্যের সরকার গড়া নির্ভর করছে। তাহলে আপনি কোন দলকে সমর্থন জানাবেন
দীনেশ দাস: দারুণ প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটায় অসুবিধা কী আছে জানেন! এত বেশি ধরুন,এত বেশি হাইপথিটিক্যাল, যে ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাবে আমার। সত্যি বলতে, আমি নির্দল প্রার্থী। বড় দলের ব্যাকিং নেই, চাপ আছে। মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলনেতাদের আশীর্বাদ নেই। কিন্তু কাজ করার ইচ্ছা, পরিকল্পনা, মিশন-ভিশন সব আছে। আপনার এত ভাবনার প্রশ্নে খুব বেশি ভেবে সময় নষ্ট করার চেয়ে, বরং ভোটারদের কাছে গিয়ে নিজের মিশন-ভিশনের কথা বলাটাই ভাল। তাই না? তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারি। আর যাই হোক আমি কারও কাছে বিকিয়ে যাবো না। বিক্রি হওয়ার হলে আমি রাজনীতি করতাম না।
প্রশ্ন: ভোট প্রচারটা একজন নির্দল প্রার্থীর কাছে ঠিক কতটা কঠিন
দীনেশ দাস: খুব কঠিন। আজকাল আই ফোন খুব দ্রুত পুরনো হয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহে নতুন দামী ফোন লঞ্চ। এখন হল ভোগবাদের জয়গান। অর্থই তোমার স্ট্যাটাস সিম্বল। গাড়ি, বাড়ি তোমার সংজ্ঞা হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ভোগবাদ, পণ্যের জয়গান। এই যুগে ভোট মানে হল টাকার খেলা। যত বেশি টাকা ছড়াবে তত তুমি সুবিধা পাবে। আমার সেসব নেই। আমার আছে অদম্য ইচ্ছা, কর্মক্ষমতা, যোগ্যতা। বিবেকানন্দের ভক্ত আমি। ওই জিনিসগুলো নিয়েই যতটা সম্ভব লড়ছি। দেওয়াল লিখন নেই, ফেস্টুন-পোস্টার নেই। যেটা আছে তাই দিয়েই লড়ছি।
প্রশ্ন: আপনার কেন্দ্রে আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ কে? তৃণমূল না বিজেপি
দীনেশ দাস: ভোট কোনও যুদ্ধ নয়, যে প্রতিপক্ষ কোনও বিশেষ লোক বা দল থাকবে। ভোট হল নীতির প্রশ্ন, এ হল বনগাঁর মানুষের পাশে থাকার প্রশ্ন। আমার প্রতিপক্ষ যদি কেউ থাকে, তা হল আমি নিজে। যে আমি বারবার আমায় বলছে, মানুষ তোমায় আর পাঁচজন নির্দল হিসেবেই ভাবছে। তখন অন্য আমিটা ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের কথা সব ভোটারদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: এমন তিনটে কারণ বলুন যার জন্য সবাইকে ছেড়ে মানুষকে আপনাকে ভোট দেবে
দীনেশ দাস: তিনটে নয় তিনশোটা কারণ আছে। তবে প্রধান তিনটে কারণ হল-১) বনগাঁয় বেকার থাকবে না সেটা নিশ্চত করব, ২) সবাই কাজ করবে, ৩) প্রকৃত উন্নয়ন হবে।