বঙ্গসংস্কৃতি:-
বঙ্গসংস্কৃতি অর্থাৎ বাংলার সংস্কৃতি আসলে কী? বাংলার সংস্কৃতিমনস্কতার সেকাল ও একাল আলোচনার পূর্বে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলতে কী বুঝি সেটা আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন।
‘বাঙালি সংস্কৃতি‘ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি… বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিত কলা, ক্রিড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ। ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিসমূহ।
এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির থেকে উৎস ভেদে পৃথক। প্রতিটি জাতির সংস্কৃতি আলাদা, প্রতিটি ভাষার সংস্কৃতি আলাদা। বঙ্গসংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। যুগে যুগে নানা জাতির মিলন ও সমন্বয় গড়ে তুলেছে বঙ্গদেশ ও বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ গোপাল হালদার হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গসংস্কৃতিকে ‘পল্লী প্রধান বাঙ্গালি সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন৷ বঙ্গীয় সংস্কৃতির বয়স আট শো অথবা বড় জোর এক হাজার বছর। কিন্তু এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের হাজার হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে।
একালের সংস্কৃতি:-
আমরা জানি সাহিত্য সমাজের দর্পন। তাই সাহিত্যকলার মধ্যেই আমরা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।
প্রাচীন বাংলার একমাত্র সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ। প্রাচীন কালে বাংলার মানুষ এক উন্নত জীবন ধারা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল…আর্যদের আগমনের পূর্বেই। বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির এটাই সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। প্রাচীনকালে বাংলার অধিবাসীদের বেশির ভাগ লোকই গ্রামে বাস করত। বাংলা চিরকালই কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির উপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এছাড়া পাট, আখ, তুলা, নীল, সর্ষে ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি। এলাচ, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলাও বঙ্গে উৎপন্ন হতো। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, হাঁস-মুরগি।
বাঙালির প্রধান খাদ্য বর্তমান সময়ের মত তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দই, ঘি, ক্ষীর ইত্যাদি। চাল নানা প্রকার পিঠা তৈরি হতো।জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার খাওয়ার প্ৰচলন ছিল। বাঙ্গালি ব্রাহ্মণেরা আমিষ খেতেন। তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত।
বাংলার নর-নারীরা যথাক্রমে ধূতি ও শাড়ি পরত। করত। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই অলংকার ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। মেয়েরা নানাপ্রকার খোপা বাঁধত। পুরুষদের বাবড়ি চুল কাঁধের উপর ঝুলে থাকত। মেয়েদের সাজসজ্জায় আলতা, সিঁদুর ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল। মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি ও নৌকা। খাল-বিলে চলাচলের জন্য ভেলা ও ডোঙ্গা ব্যবহার করত। মানুষ ছোট ছোট খাল পার হতো সাঁকো দিয়ে। নানা রকম খেলাধূলা ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। পাশা ও দাবা খেলা প্রচলিত ছিল। তবে নাচ- গান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল খুব বেশি। কুস্তি, শিকার, ব্যয়াম, নৌকাবাইচ ও বাজিকরের খেলা সে যুগেও পুরুষদের খুব পছন্দের ছিল। প্রাচীনকাল হতেই বঙ্গদেশ কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। মোটের উপর সুখের জীবন ছিল তাদের। প্রাচীন বাংলার মানুষ এক উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, যারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাঙ্গালী সমাজ।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বাংলার সংস্কৃতির চিত্র টুকরো টুকরো করে ফুটে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও ধর্মীয় গণচেতনার যুগ।
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে আমরা প্রাচীন যুগেরই রেশ পায়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই বাংলাদেশে যে মুসলমান শাসনকাল শুরু হয়েছিল, তা স্থায়ী হয় প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর। বহিরাগত এই শাসন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় সামাজিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে বাঙালির এই নতুন পরিচয় স্বাভাবিক ভাবেই তার জীবন , সাহিত্য , সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার উপর প্রভাব ফেলেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে তখন শুরু হয় ধর্মান্তরীকরণ প্রক্রিয়া। যদিও ধর্মান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কারের প্রভাব থেকে এই দেশীয় মুসলমানদের তখনও মুক্তি ঘটেনি । হিন্দুদের মত মুসলমানরাও বিধবা রমণীকে বিয়ে করতেন না । এমণকি বাগদত্ত পুরুষের মৃত্যু হলে বাগদত্তা নারীকে বিধবা রমণীর নিয়মকানুন পালন করতে হত। কাঁচের চুড়ি , সোনার অলংকার, জমকালো পোশাক পরিধান করা, এসব কিছুই নারীদের ব্যবহার করা রীতি বিরুদ্ধ ছিল। বিয়েতে পণ গ্রহণের রীতি ছিল এবং মৃত্যুর পর স্বামীর পাশে স্ত্রীকে কবর দেওয়া হত। মুসলমান মহিলারা গর্ভে পুত্রসন্তান ধারণের উদ্দেশ্যে হিন্দু নারীর মতই নানা রীতি ও সংস্কার যেমন, মন্ত্রপূত জল, ঔষধ, কবচ-তাবিচ ইত্যাদি ধারণ করতেন। কোথাও যেন দুটো ধর্ম একই ছত্রছায়ায় প্রতিভাত হত। হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যে আমরা তার প্রভাব দেখতে পাই।
কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বলেছেন,
“বাংলার কোন কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান দুর্গা-কালী প্রভৃতির পূজা করতেন, একথা সুপ্রসিদ্ধ। এর বড় কারণ বোধহয় এই যে, ওয়াহাবী আন্দোলনের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীক চর্চার একান্ত বিরোধী ছিল না। পীরের কবরে বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন, দিন-ক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা, সমাজে একশ্রেণির জাতিভেদ স্বীকার করা এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল।”
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ সত্ত্বেও একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠার দরুণ অনেক বাঙালি মুসলমান কবিরা তখন হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। প্রাক মুগল যুগে সাবিরিদ খাঁ প্রমুখ কবিরা লৌকিক কাহিনীর ছত্র ছায়ায় লৌকিক দেবদেবীর প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধাই প্রকাশ করেছেন। সাবিরিদ খাঁ তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের সূচনাতেই দেবী কালিকার বন্দনা গান করে স্বরচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক জুড়ে দিয়েছেন।
হিন্দুশাস্ত্র ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও শ্রদ্ধা এই কাহিনীতে প্রকাশ পেয়েছে। এই সমন্বয়ের ক্ষেত্র গড়ে তোলা ও লালন করার ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সুফিবাদীরা।
সেকালের সংস্কৃতির মধ্যে সামাজিক সংস্কৃতিই বেশি লক্ষ করা যায়। আর সংস্কৃতির স্তম্ভ হলো গ্রাম। সেখানে দেখা যায় সমাজের কেউ বিপদে পড়লে বাকিরা তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে সাহায্য করেছে। প্রতিবেশীর বিপদ মানেই সমাজের প্রতিটা মানুষের বিপদ।
একালের সংস্কৃতি:-
সেকালের সংস্কৃতির সঙ্গে একালের সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়।
আধুনিক কালের সংস্কৃতির যে দ্রুত পরিবর্তন তা কিন্তু আমরা লক্ষ্য করে চলেছি। শাসক-শাসিত, প্রজা-আমাত্য, সাহিত্যিক-পাঠক সবার প্রচেষ্টাই বাংলা ভাষা আধুনিকতায় প্রবেশ শুরু করেছিল।
সর্বশেষ টাইপ বা গদ্যের স্টাইলে বাংলার আবির্ভাব তো খ্রিস্টান মিশনারিদের দৌলতেই হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যের সূচনায় এলেন ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম চন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তি। যাদের সাহিত্যে ধরা পড়ল বিবর্তন। চলিত গদ্যে বাংলা হলো সাবলীল। এ ভাষায় আত্মীকৃত করেছে যুগে যুগে যারা আমাদের দেশে রাজত্ব করে গিয়েছে তাদের সকলের ভাষা।
যেমন- নামাজ, রোজা,আনারস, চেয়ার, টেবিল, হুক্কা, খোদা, শয়তান, রাসুল, নবি, মোবাইল, ফেসবুক ইত্যাদি।
‘বিনোদন’ বলতে শুধু যাত্রা বা গ্রামে গ্রামে গানের আসর বসত। মারফতি, বাউল, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া কত রকম গান হতো, আর এখন বিনোদনের উপাদানের অভাব নেই।
কালের প্রবাহে বাংলা সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তন সতত চলমান। পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও আত্মীকরণ একটি আধুনিক সংস্কৃতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্টটিকে আমাদের স্বীকার করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়…হেথায় আর্য-অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, শক, হুন কিংবা মোঘল, পাঠানদের এক দেহে লীন হবার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
আর এজন্যই বাংলা একটি আধুনিক ভাষা; বাঙালিরা একটি আধুনিক সংস্কৃতির অধিকারী জাতি। বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি তা আবহমান কাল থেকে এক পরম্পরায় চলে আসছে। তবে বাঙালি সংস্কৃতি যতটা সমৃদ্ধ অন্য কোনো সংস্কৃতি এতটা সমৃদ্ধ নয়। বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় গুণটা মানবতাবাদ। পরস্পরের ভালোবাসা।
সঙ্গীতেও সংস্কৃতির বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
তবে বর্তমানে সংস্কৃতি হচ্ছে মিশ্র সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি। বাঙালিয়ানা বলতে যা বোঝায় সেটা আর কেউ বহন করে না। বরং আমরা অন্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব বোধ করি।
এর থেকে মুক্তির উপায় নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি কে ভালোবাসা ও সম্মান দান।