পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র ছিল নেপাল। ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেই দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে স্বীকৃত ছিল হিন্দু ধর্ম। ওই বছরেই নেপালের গণপরিষদ রাজতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর খুব স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্রের তকমা হারায় নেপাল। যদিও ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গিয়েছে সেই দেশের ৮১.৩ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে নেপালের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এক অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ২০১৭ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট দলগুলোর প্রতি সমর্থন জানালেও তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নাস্তিক নয়, বরং সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় মতের প্রতি আস্থাশীল। ঘটনা হলো ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে সেই দেশে যতগুলি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জয়লাভ করেছে সেই দেশের কমিউনিস্ট দলগুলি।

নেপালের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বরাবরই ছিল। এমনকি সেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বাঁকের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কখনই অস্বীকার করা যাবে না। ভারতের সক্রিয় ভূমিকার কারণেই তাদের অপর প্রতিবেশী দেশ চিন অতীতে চেষ্টা করেও নেপালের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে বারেবারে ব্যর্থ হয়েছিল। এই পাহাড়ি দেশে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অতীতে চিনের এই ব্যর্থতা এবং বর্তমানের সাফল্যের সঙ্গে ভারতের ঘরোয়া রাজনীতির উত্থান-পতন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

images 7 11
নেপালের কমিউনিস্ট নেতা প্রচন্ড, source- The India Awaaz

চলতি শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত যেহেতু ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রাধান্য ছিল, তাই নেপালের রাজনীতিতে ভারত বরাবরই সেই দেশের সমভাবাপন্ন রাজনৈতিক সংগঠন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে যদি মনে হয় নেপালের বাকি রাজনৈতিক দলগুলি বা তৎকালীন রাজাদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বা সম্পর্ক বিশেষ ছিল না, তাহলে সেটা ভুল ভাবনা হবে। কারণ এক প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে কেবলমাত্র যোগাযোগ রেখে তা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্যের মূল ব্যাখ্যা হল নেপালি কংগ্রেসের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব বরাবরই ছিল ভারতের শাসক দল কংগ্রেসের।

সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রীয় স্তরে নেপালের সঙ্গে যে যোগাযোগ তার বাইরে গিয়ে নেপালি কংগ্রেসের শীর্ষস্তরের নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের, বিশেষ করে কংগ্রেসের শীর্ষস্তরের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। একাধিক নেপালি কংগ্রেস নেতা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ব্যক্তিগত সখ্যতা সেই দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের সহায়ক হয়েছিল।

নেপালের রাজতন্ত্রের যখন অবসান ঘটছে সেই সময় সেই দেশের মূল ধারার কমিউনিস্ট দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)’র সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করেও খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেননি কংগ্রেসের শীর্ষস্তরের বাঘা বাঘা নেতারা। তাদের তখন বাধ্য হয়ে সিপিআই(এম)’র তৎকালীন পলিটব্যুরো সদস্য এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির শরণাপন্ন হতে হয়। এই ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। ইউপিএ সরকারের মুশকিল-আসান বলে পরিচিত এবং সরকার ও দলে “নাম্বার টু” প্রণব বাবু যাবতীয় অহংবোধ ঝেড়ে ফেলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সীতারাম ইয়েচুরির সাহায্য নিয়েছিলেন।

images 8 13
নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল;
source- www.vimarshnews.com

প্রণব বাবুর সেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত সহ আরো নানান বিষয় কিভাবে নেপালের চলতি রাজনৈতিক গতিপথের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে সেগুলোই এখন একটু ফিরে দেখব।

১) ইয়েচুরির ভূমিকা চীনকে হতাশ করে

হেডলাইন পড়ে অনেকে মনে করবেন সিপিআই(এম) ও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যবর্তী কোনো দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু না, এই বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নেপালের রাজনীতি সংক্রান্ত। ২০০৮ সালে বাধ্য হয়ে নেপালের তৎকালীন রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকেন। সেই অধিবেশনে যোগ দিতে নেপালের মূল ধারার বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল রাজি হলেও নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) দলটি রাজি হচ্ছিল না। এই দলের নেতা মাধব কুমার নেপাল পরিষ্কার জানান পুরানো সংসদে যেহেতু নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)’দের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাই তারাও এই অসম্পূর্ণ সংসদে অংশগ্রহণ করবে না।

ঘটনা হল ততদিনে নেপালের বেশিরভাগ মানুষ মাওবাদীদের সমর্থক হয়ে উঠেছে। অথচ শেষ সংসদীয় নির্বাচন বয়কট করায় তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না সেই দেশের পার্লামেন্টে। এই পরিস্থিতিতে নেপালের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সামনে এগিয়ে যাওয়ার বদলে আরো জটিল হয়ে উঠছে দেখে প্রণব মুখোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন সরকারির স্তরে সেই দেশের কমিউনিস্ট দলগুলোকে বুঝিয়ে ওঠা অসম্ভব। বরং তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বললে কাজের কাজ হতে পারে। এমন একজনকে এক্ষেত্রে দায়িত্ব দিতে হবে যাকে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করে সেখানকার কমিউনিস্ট দলগুলি।

images 9 11
নেপালের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বাবুরাম ভট্টরাই;
source- The Himalayan Times

যেমন ভাবা তেমন কাজ করেন প্রণব বাবু। তিনি সরাসরি কথা বলেন সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে। ঘটনা হলো পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ড নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)’র সঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সুসম্পর্ক বেশি ছিল। তারা দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে এসেছে তার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় অংশ চীনের কাছ থেকেই পেত। কিন্তু ওই বিপ্লবী কমিউনিস্ট দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি বাবুরাম ভট্টরাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল ইয়েচুরির। অন্যদিকে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)’র সাধারণ সম্পাদক মাধব কুমার নেপালের সঙ্গেও ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল তার। কারণ মাধব কুমার নেপাল নেতৃত্বাধীন দলটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতো।

এই পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকদিন ভারতের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে ইয়েচুরি নতুন সমাধানের পথ বের করেন। তার প্রস্তাব অনুযায়ী নেপালের সমস্ত রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্ট পুনরুজ্জীবনের বদলে গণপরিষদ গঠন করার বিষয়ে সম্মত হয়। তাদের এই সিদ্ধান্ত মাওবাদী নেতা প্রচন্ড মেনে নেন। এর ফলে সেই দেশের নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গণপরিষদ গঠন করার জন্য। পরবর্তীতে এই গণপরিষদ নেপালের নতুন সংবিধান রচনা করে।

এই সময় চিন ভেবেছিল নেপালের অস্থির রাজনৈতিক অবস্থাকে ব্যবহার করে তারা সেই দেশের মাওবাদীদের সমর্থন করবে এবং মাওবাদীরা দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিলে স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশের ওপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইয়েচুরির ভূমিকা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় পরিকল্পনাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিল ২০০৮ সালে।

২) বিজেপির উত্থানে লাভ হয়েছে চিনের

হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সঙ্গে নেপালের রাজ পরিবার ও রাজতন্ত্র ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের দীর্ঘদিন ধরেই সুসম্পর্ক ছিল। এর ফলস্বরূপ সেই দেশের নেপালি কংগ্রেস সহ মূল স্রোতের কমিউনিস্ট দল এবং মাওবাদীদের সঙ্গে তাদের কিছুটা বৈরিতার সম্পর্কই গড়ে ওঠে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতা দখল করলে নেপালের রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় নেতাদের যে সুসম্পর্ক ছিল তাতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বলতে গেলে এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরের যোগাযোগ ছাড়াও যে “ট্র্যাক টু” পর্যায়ের যোগাযোগ দীর্ঘদিন ধরে ছিল, তার সুতোটা কেটে যায়।

images 10 9
নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ওলি; source- OrissaPost

প্রটোকল মেনে চলা রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে যে অনেক ফারাক আছে তা সবাই বোঝেন। অন্যদিকে নেপালের রাজতন্ত্রের প্রতি বিজেপির অতীত সমর্থনের বিষয়টি নিয়ে কখনোই স্বস্তি বোধ করেনি সেই দেশের রাজনৈতিক নেতারা। তার ফলেই বোধহয় ভারতের প্রতি তাদের আস্থা এবং ভরসা বেশ কিছুটা টলে যায়। তারা নতুন মিত্র হিসাবে চিনের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে।

অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বামপন্থীদের সঙ্গে বিজেপির চিরশত্রুতা থাকায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেপালের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মতো বিষয়ে ইয়েচুরির মতো বামপন্থী নেতাদের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না বিজেপি নেতৃত্ব। যার ফলশ্রুতিতে নেপালের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে এক বিপুল দূরত্ব তৈরি হয়। সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকা চিন এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সেই দেশে অল্প কয়েকদিনেই নিজের প্রভাব শতগুণে বৃদ্ধি করে ফেলেছে।

৩) ভারত-চিন দ্বন্দ্ব সীমানা ছাড়িয়ে নেপালে পৌঁছেছে

ভারত ও চিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ১৯৪৯ সালে চিন স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে। তার ফলে ১৯৬১ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ হয়। এই ঘটনা সবার জানা এবং বর্তমান সময়ে ডোকালাম, লাদাখ সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথাও কারও অজানা নয়। অজানা নয় এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। দুই দেশ‌ই পরস্পরের উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই সব‌ কিছুও জানা ব্যাপার। তা সব কিছুই যদি জানা হয়, সেক্ষেত্রে অজানা কি আছে! অজানা কিছু না থাকলেও বিশ্লেষণ করার অনেক কিছুই আছে।

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপাল অবস্থানগতভাবে ভারত এবং চিন দুই দেশের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেপালের সঙ্গে ভারতের যতটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তা চীনের সঙ্গে গড়ে ওঠেনি। সেই দেশের শেষ ‘শাহ’ রাজবংশ গড়ে তুলেছিল ভারতের রাজপুতরাই। সেই দেশের বর্তমানের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন ভারত থেকে। এমনকি একাধিকবার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে তারা ভারতে আত্মগোপন করেছিলেন।

এত সুস্থ আত্মিক যোগাযোগ যে দেশের মানুষ এবং রাজনীতিবিদদের সঙ্গে, স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক আদান-প্রদানও বেশি হবে। অনুন্নত এবং পাহাড়ি রাষ্ট্র হওয়ায় নেপাল একাধিক বিষয়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সেই দেশের নতুন সংবিধান নিয়ে তরাই অঞ্চলের বসবাসকারী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলি বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করলে স্বাভাবিক মতাদর্শগত কারণে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার নেপালে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম সহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল বেশ কিছুদিনের জন্য।

এর ফলে নেপালের মানুষের জীবন ধারণ করাই একরকম। অসম্ভব হয়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের জীবন রক্ষার তাগিদে নেপাল চিনের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। ঠিক যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল চিন। তারা নেপালের চাহিদামত সাহায্য করে, সেই সঙ্গে ওই পাহাড়ি রাষ্ট্রে একাধিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই নেপালের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক অতীতের তুলনায় অনেকটাই উন্নত হয়। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে তাদের আগের সখ্যতাও আর থাকে না।

images 11 9
নেপালের সংসদ ভবন; source- Indus Scrolls

এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেপালের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ভারত ও চিন দুই পক্ষে যেন বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একদল রাজনীতিবিদ যেমন চিনপন্থী অবস্থান গ্রহণ করছে, তেমনি একদল চিরাচরিত প্রথামেনে ভারতকেই তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করে। অথচ এই ঘটনার আগে সেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক না কেন তারা একটা বিষয়ে এক ছিল। সবাই ভারত এবং ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের তাদের বন্ধু মনে করত।

৪) ভারত-চিন দ্বন্দ্বে বিপন্ন নেপালের গণতন্ত্র

২০১৭ সালে নেপালের প্রধান দুটি কমিউনিস্ট পার্টি নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ও নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) একসঙ্গে মিলে মিলে গিয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলে। এই নতুন দলের চেয়ারম্যান হন খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি এবং কার্যকারী চেয়ারম্যান হন পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ড। ওই বছরই নেপালের জাতীয় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করে নবগঠিত নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হন দলের চেয়ারম্যান খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি।

এই তিন বছর সরকার চালানোর মধ্যবর্তী সময়ে অদ্ভুত ভোল বদল ঘটে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে। ওলি ছিলেন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)’র নেতা, কিন্তু নতুন দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পর তার পূর্বতন দলের মাধব কুমার নেপাল, বামদেব গৌতমের মতো শীর্ষ স্তরের নেতারা একে একে পূর্বতন মাওবাদী নেতা প্রচন্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকায় অলির সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

দলে প্রধানমন্ত্রী ওলির প্রতিদ্বন্দ্বি শিবিরের নেতা প্রচন্ড ভারতের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। যদিও বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক না থাকলেও সীতারাম ইয়েচুরির মাধ্যমে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভারতের সঙ্গে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অনেকে মনে করেন ভারত-চিন দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে। এশিয়ার এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ নিজেদের স্বার্থে নেপালের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এই মুহূর্তে ভারতপন্থী এবং চিনপন্থী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে নেপালে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। সেই পরিস্থিতির ফায়দা নিতে ভারত ও চিন দুই পক্ষই তৎপর এখন। যদিও ঘুরিয়ে বলা যায় ভারত-চিনের দ্বন্দ্ব নেপালের মাটিতে পৌঁছানোর ফলেই নেপালের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে!

৫) ভারত-চিনের সীমান্ত দ্বন্দ্বে নেপাল হাতিয়ার মাত্র

লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চিনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ- চিন দাবি করে থাকে অরুণাচল প্রদেশ দক্ষিণ তিব্বতের অংশ হিসাবে তাদের অংশ এবং লাদাখের একাংশ‌ও নাকি ভারত দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে ভারতের দাবি চিন বরং লাদাখের উত্তরাংশ অর্থাৎ আকসাই চিন বেআইনিভাবে দখল করে রেখেছে এবং অরুণাচল প্রদেশ দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

হিন্দু,
নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী; source- Dreams & Ideas

এই দ্বন্দ্বে নতুন মোড় নেয় নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ওলির নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ঘোষণা করে ভারতের লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা নেপালের অংশ। ঘোষণা মতো তার সরকার নেপালের নতুন ম্যাপ পর্যন্ত প্রকাশ করে দেয়। যদিও ভারত এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে অভিযোগ করে চিনের মদতেই সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী এই পদক্ষেপ করেছে।

এই পর্ব থেকেই নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে ভারত ও চিনের প্রতি আনুগত্য নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এই সময় থেকেই দেখা যায় নেপালের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছেন সেদেশে নিযুক্ত চিনা রাষ্ট্রদূত। তিনি নেপালের ঘরোয়া রাজনীতি নিয়ে একাধিকবার সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। যে ভূমিকা অতীতে ভারত পালন করে থাকতো।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যাচ্ছে নেপালের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে চিনের প্রভাব অতীতের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ভারত চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে নেই। আর তারা হাত গুটিয়ে বসে নেই বলেই নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি সরাসরি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে নেপালি কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়ে গিয়েছে নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে। সেই সাংবিধানিক বেঞ্চ সংসদ ভাঙার নির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

পরিশেষে একটা কথাই বলা যায় একবিংশ শতকের রাজনীতির ধারা মেনেই নেপাল তার দুই প্রবল শক্তিশালী প্রতিবেশীর দ্বন্দ্ব ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই দুই দেশ নিজেদের স্বার্থেই নেপালের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ কোনমতেই হাতছাড়া করতে চাইবে না।