পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফল ইতিমধ্যেই সকল রাজ্যবাসী জেনে গিয়েছেন। ২১৪ টি আসনে জয়ী হয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তৃতীয় বারের জন্য বাংলার মসনদে বসতে চলেছে তৃণমূল জোট। জোড়া ফুল শিবির এককভাবে ২১৩ টি আসনে এবং কার্শিয়াং কেন্দ্রে তৃণমূল সমর্থিত বিনয় তামাং পন্থী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা একটি আসনে জয়লাভ করে। বিজেপি শেষ পর্যন্ত ৭৭ টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে। অপরপক্ষে সংযুক্ত মোর্চার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে নবগঠিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট মাত্র ১ টি আসনে জয়ী হয়। ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ভোটের আগে দু’জন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে দুটি কেন্দ্রের ভোট গণনা স্থগিত আছে। এই হল চুম্বককে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল‌ কিন্তু এই ফলের গুরুত্ব এখানে শেষ নয়, বরং শুরু হল। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব এই ফলাফলের ভিত্তিতে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে এলো এবার।


১) মমতার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন-

তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, কাটমানি খাওয়া, সিন্ডিকেট রাজ চালানোর মতো অভিযোগ নতুন নয়। এই সমস্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিতে পারেন না তৃণমূল নেতারাও। কিন্তু এই ভোটের ফল পরিষ্কার করে দিল গোটা বাংলা জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি একই রকম আছে। সাধারণ মানুষ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আজও নিজেদের আপনজন, ঘরের মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করেন তারা। সেই কারণেই সবকিছু ভুলে তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল নেত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চেয়ে ভোট দিয়েছেন মানুষ।


২) বাংলার রাজনীতির বিবর্তন-

আগেকার দিনের মতো শুধুমাত্র আদর্শভিত্তিক এবং সংগঠনের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক যুদ্ধে যে জেতা যাবে না তা পরিস্কার করে দিল পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোট। ফলাফল থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে প্রশান্ত কিশোরের মত পেশাদার ভোট পরামর্শদাতার উপযোগিতার বিষয়টি। উনিশের লোকসভা নির্বাচনের পর তৃণমূলের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক কাঠামো যে বিশাল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে তৃণমূল তবে কী করে এই ধাক্কা সামলে এরকম বিপুল সাফল্য অর্জন করল? কারণ এখানেই মূল ভূমিকা প্রশান্ত কিশোরের। তিনি পরামর্শ দিয়ে দলীয় সংগঠনের খামতি বুঝতে না দিয়ে আম জনতার কাছে দল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাই এবারের ভোটে সাধারণ মানুষ দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করেছে তৃণমূলকে। পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আগামী দিনে বাংলার রাজনীতিতে নির্বাচনী রণকৌশল রচনাকারী বিশেষজ্ঞদের কদর উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে।


৩) দলবদলুদের জায়গা নেই বাংলায়-

শুভেন্দু অধিকারী, তাপসী মন্ডল, বিশ্বজিৎ দাসের মত অল্প কয়েকজন নেতা বাদ দিলে তৃণমূল এবং কংগ্রেস থেকে যারা বিজেপিতে গিয়েছিলেন সেই দল পরিবর্তনকারী নেতাদের প্রায় প্রত্যেকেই এবারের নির্বাচনে মুখ থুবরে পড়েছে। এই ঘটনা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অনেক মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিল। প্রমাণ হয়ে গেল ক্ষমতায় থাকার জন্য যারা যাবতীয় নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দল পরিবর্তন করে তাদেরকে সাধারণ মানুষ কখনও ক্ষমা করে না। এর ফলে আগামী দিনে ভোটে জেতার জন্য দলবদল করার আগে বাকি নেতারা দশ’বার ভাববেন।


৪) মমতা নয়, মাঝারি স্তরের নেতাদের ওপর ক্ষোভ ছিল-

এবারের নির্বাচনের ফলে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে কোনও ক্ষোভ ছিল না। সমস্ত ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু মাঝারি স্তরের তৃণমূল নেতাদের প্রতি। স্বাভাবিকভাবেই নেতারা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ায় নতুন করে জোড়া ফুল প্রতীকে ভোট দিতে আর দ্বিতীয়বার দ্বিধা করেনি মানুষ। বিজেপিকেও এর ফল ভুগতে হয়েছে। মানুষ যাদের অপছন্দ করে সেই নেতাদের দলে নেওয়ার ফলে বিজেপির এত খারাপ ফলাফল হল।


৫) সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা নেই বাংলার মাটিতে-

এবারের নির্বাচনী ফল এটুকু পরিষ্কার করে দিয়েছে বাংলার মানুষ সার্বিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত। তারা কখনোই সার্বিকভাবে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করা পছন্দ করেন না। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে লড়াই করেনি বিজেপি। সম্ভবত সেই কারণেই তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিল তারা।

যদিও একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা দখলের লক্ষ্যে ধর্মীয় মেরুকরণকেই প্রধান হাতিয়ার করে গেরুয়া শিবির। সম্ভবত সেই কারণেই তৃণমূলের ওপর ক্ষুব্ধ হলেও ভোটারদের একটা বড়ো অংশ বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছে যেকোনো মূল্যে ধর্মের রাজনীতিকে আটকে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল পশ্চিমবঙ্গবাসী।


৬) বহিরাগত ইস্যু সফল-

বাংলার ভোট প্রচারে বিজেপি যদি দিলীপ ঘোষ-মুকুল রায়ের ওপর অনেক বেশি আস্থা রাখতো তাহলে হয়তো তাদের ফলাফল অনেকটা ভালো হতে পারতো। যেভাবে দলবেঁধে গণহারে দিল্লির উপর থেকে নিচুতলার বিজেপি নেতাদের বাংলায় আগমন ঘটেছে সেটা রাজ্যবাসী ভালো নজরে দেখেনি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে হয়েছিল বিজেপি ক্ষমতায় আসলে রিমোট কন্ট্রোল থেকে যাবে দিল্লির হাতে। বাঙালি একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে ঠিক করে ঠিক ভুল যাই হোক রিমোট কন্ট্রোলটা কখনও বাঙালির হাত থেকে ছাড়া চলবে না। সেই কারণেই তৃণমূলের প্রচার করা বহিরাগত ইস্যুতে সম্মতি জানিয়েছেন রাজ্যের ভোটারদের বেশিরভাগ অংশ।


৭) নো ভোট টু বিজেপি মুভমেন্ট-

স্বাধীন বামপন্থী এবং নকশালপন্থীদের নেতৃত্বে রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠেছিল নো ভোট টু বিজেপি আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল কথাই ছিল আর যাকে ভোট দাও বিজেপিকে নয়। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশের মানুষ। তারা বিজেপিকে আটকাতে সবচেয়ে শক্তিশালী দল তৃণমূলকে ভোট দেয়। এক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের ভালো কাজ বা ত্রুটি কোন‌ও কিছুই বিচার্য হয়নি। মূল উদ্দেশ্য ছিল যেভাবে হোক তৃণমূলকে আটকাতে হবে।


৮) সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বাম নেতৃত্ব-

যে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে তাদের করুন পরিনতি ঘটল এবারের নির্বাচনে। এই ভোটের ফল পরিষ্কার করে দিচ্ছে এ রাজ্যের বাম দলগুলির নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা অবশিষ্ট নেই সাধারণ মানুষের কাছে। তাই বামেদের ঘুরে দাঁড়াতে হলে শুধুমাত্র নতুন নেতৃত্ব নয়, নতুন করে পথ চলা শুরু করতে হবে।


৯) কংগ্রেস এবং আইএসএফ এর সঙ্গে জোট প্রত্যাখ্যান করেছে মানুষ-

বামপন্থী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার আগে থেকে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। এ রাজ্যের একটা বড়ো অংশের মানুষ স্বাভাবিক চেতনাতেই বামপন্থী। তারা সকলে বাম রাজনীতির ওপর আস্থা হারিয়েছেন ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। বরং এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস এবং পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে বামফ্রন্টের জোটকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আইএসএফ এর সঙ্গে হাত মেলানোকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বামেদের আপস হিসেবে তুলে ধরেন তারা। এই অংশের মানুষের ভোট অনেকটাই তৃণমূলের দিকে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে বামপন্থীদের একক পথে চলা উচিত। সেক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং আইএসএফ এই দুই দলের সঙ্গ ছাড়তে হবে।


১০) বিজেপি মানেই অপ্রতিরোধ্য নয়-

একুশের বাংলার ভোট রাজ্য ছাপিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দিলো যে বিজেপি মানে অপ্রতিরোধ্য নয়। স্বাভাবিকভাবেই গেরুয়া শিবির যে শুধুমাত্র বাংলার ভোটে হেরে গিয়েছে তা নয়, এর ফলে আগামী দিনে তাদেরকে দেশের প্রতিটা নির্বাচনে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিরোধী দলগুলি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফল থেকে যে আত্মবিশ্বাস সংগ্রহ করল তা আগামী দিনে বিজেপিকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সম্ভবত এই আত্মবিশ্বাস থেকেই ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার লড়াই শুরু হয়ে যাবে।