হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপাল ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র। বিভিন্ন ঐতিহাসিক আখ্যান এবং পুরাণেও নেপালের সঙ্গে ভারতের আর্থিক বন্ধনের কথা উল্লেখ আছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে এই গোটা ভূখণ্ডকে এই একটি দেশের অন্তর্গত বলে ধরা হত। পরবর্তীকালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে নেপালকে পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে তুলে ধরে ইংরেজরা। যদিও তৎকালীন নেপালের রাজ পরিবারের সঙ্গে স্বাধীন ভারতের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল ছিল।
নেপালের শেষ রাজপরিবার শাহ’দের সঙ্গে জহরলাল নেহেরু সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রত্যেকেরই সম্পর্কে যথেষ্ট ভাল ছিল। তবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নেপালের এই হিন্দু রাজাদের। এই সম্পর্ক সম্ভবত ধর্মীয় কারণ থেকেই গড়ে উঠেছিল। অপরপক্ষে তৎকালীন নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালী কংগ্রেসের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। সে দেশের রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন চলার সময় নেপালী কংগ্রেসের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান।
রাজ বিরোধীদের নিজেদের দেশে আশ্রয় দিলেও নেপাল রাজ পরিবারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনোই খারাপ হয়নি। অদ্ভুত এক ভারসাম্য বজায় রেখে প্রতিমুহূর্তে চলতে পেরেছে দিল্লি। পরবর্তীকালে নেপালের রাজতন্ত্রের অবসান হয় মাওবাদীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কারণে। এর পরবর্তী পর্যায়ে নেপালী কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে সে দেশে জায়গা করে নিয়েছে কমিউনিস্টরা। ঘটনা হল সে দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের একাংশের সঙ্গে আগের মতোই সুসম্পর্ক আছে ভারতের। তবে খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি’নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক শুরু থেকেই বিশেষ মধুর নয়।
যে মাওবাদীদের আন্দোলনের কারণে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল এবং গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিল হিমালয়ের পাদদেশের এই দেশটি, সেই মাওবাদী নেতা প্রচন্ডের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সম্পর্ক প্রথম দিকে খুব একটা ভালো ছিল না। পরবর্তীকালে কেপি শর্মা ওলি নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী চীন ঘনিষ্ঠ হিসেবে উঠে আসলে পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ড নেতৃত্বাধীন শিবির ভারত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। যদিও প্রচন্ডের সঙ্গে বর্তমান শাসক দল বিজেপির সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। বরং তিনি অনেক বেশি কংগ্রেস ও এদেশের বামপন্থী দলগুলোর ঘনিষ্ঠ।
অপর পক্ষে ওলির দলের বিরোধী গোষ্ঠী তথা নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট নেতা মাধব কুমার নেপালের সঙ্গে বরাবরের সুসম্পর্ক ভারতের। নেপালের মাওবাদী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য তথা বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং মাধব কুমার নেপালের সাহায্যেই প্রচন্ডের সঙ্গে মধ্যস্থতা গড়ে তুলেছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকার।
এই পরিস্থিতিতে ১০ মে খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি নেতৃত্বাধীন নেপালের কমিউনিস্ট সরকার সংসদের নিম্নকক্ষে আস্থা ভোটে পরাজিত হয়। এরপরই জল্পনা শুরু হয়েছিল নেপালী কংগ্রেসের প্রধান শেরবাহাদুর দেউবা নেপালের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। কিন্তু সমস্ত সম্ভাবনাকে শেষ মুহূর্তে ধুলিস্যাৎ করে দিলেন ওলি। তার রাজনৈতিক সূক্ষ্ম চালের ফলে নেপালী কংগ্রেস ১৩৬ জন সাংসদের সমর্থন জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও শপথ নিলেন কেপি শর্মা ওলি।
নেপালে খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি আস্থা ভোটে হেরে গিয়েও পুনর্বার সরকার গঠন করায় যে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে এলো তাতেই আমরা চোখ রাখব।
১) প্রচন্ডের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেল-
গণতন্ত্রের পথে নেপাল পা বাড়ানোর পর সে দেশে কিং মেকারে পরিণত হয়েছিলেন পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ড। একাধিকবার তিনি সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে কোনও সময়ই তার আমলে সরকার স্থায়িত্ব লাভ না করলেও তার সমর্থন ছাড়া কেউ এর আগে সরকার গঠন করতে পেরেছে এরকমটা দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে প্রচন্ড যাকে সমর্থন যুগিয়েছেন তিনিই গণতান্ত্রিক নেপালে সরকার গঠন করতে পেরেছেন। এমনকি কেপি শর্মা ওলি’ও বাধ্য হয়েছিলেন প্রচণ্ড গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাতে।
১০ মে আস্থাভোটে প্রধানমন্ত্রী ওলি হেরে যাওয়ার পিছনে প্রচন্ডের হাতযশ ছিল। কিন্তু এবার সেই প্রচন্ড নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে তরাইয়ে মধেশীয়দের জনতা সমাজবাদী পার্টির একাংশের সমর্থন নিয়ে ওলি সরকার গঠন করায় নেপাল রাজনীতির কিং মেকারের তকমা হারাতে হল প্রচণ্ডকে, যা তার ‘প্রচন্ড’ ভাবমূর্তিকে প্রায় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
২) চিনের পৌষ মাস, ভারতের সর্বনাশ-
নতুন করে প্রধানমন্ত্রী পদে ওলি শপথ নেওয়ায় নেপালে প্রমাণ হয়ে গেল তিনি বর্তমানে সে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হবে চিন। কারণ ওলি বরাবর চিন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে ঘিরে ফেলার নিতীতে নেপালকে আরও কাছে টানতে সক্ষম হবে লাল চিন। উল্টোদিকে ওলির কারণেই ভারতের সঙ্গে নেপালের দূরত্ব কিছুটা হলেও বেড়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত বাধা ছিন্ন করে ওলি আবার নতুন করে ক্ষমতায় আসার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত বেশ কিছুটা বিপাকে পড়ল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। মুখে দিল্লি কোনও কিছু না বললেও তারা যে এই বিষয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে তা ইতিমধ্যেই বোঝা গিয়েছে।
৩) মাধব কুমার নেপালের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সঙ্কটে-
নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল প্রধানমন্ত্রী ওলি’র নেতৃত্বাধীন নেপালী কমিউনিস্ট পার্টি’র বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা। মূলত তার ২৮ জন অনুগামী ১০ মে সংসদে ভোটদানে বিরত থাকাতেই ওলি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তার সঙ্গে অপর কমিউনিস্ট নেতা প্রচণ্ডের সম্পর্ক বর্তমানে যথেষ্ট ভালো। তারা দুজনেই ওলির বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন একসঙ্গে। যদিও আদর্শগত কারণে মাধব কুমার নেপাল সরাসরি প্রচন্ডের সঙ্গে হাত মেলাতে পারছেন না।
এই পরিস্থিতিতে ওলি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ায় সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়লেন মাধব কুমার নেপাল। কারণ তার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তাকে পিছনে ঠেলেই খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলির উত্থান ঘটেছিল। এই পরিস্থিতিতে তাকে হয় প্রচণ্ডের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে, না হলে ওলির সঙ্গে আপোষ করে নিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এখন কোন পথে হাঁটেন সেটাই দেখার।
৪) নেপালি কংগ্রেসের ব্যর্থতা আসলে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয়-
গোটাটাই নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় হলেও ভারত সরকারের উচিত ছিল তাদের বরাবরের বন্ধু নেপালী কংগ্রেস যাতে সরকার গঠন করতে পারে সেই বিষয়ে তদবির করা। সূত্রের খবর নয়াদিল্লি একেবারে যে এই বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল তা নয়। তারা খুব সুচারুভাবে তলায় তলায় চেষ্টা করেছিল যাতে নেপালী কংগ্রেসের শেরবাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন হয়। কিন্তু ঘটনাক্রম প্রমাণ করে দিচ্ছে নয়াদিল্লির যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই কূটনৈতিক পরাজয় আগামী দিনে অনেক বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। কারণ প্রতিবেশী নেপালের কূটনীতির মোকাবিলা করতে যে সরকার ব্যর্থ হয় তারা তাবড় তাবড় দেশের কূটনীতিক চাপ সামলাবে কি করে এই প্রশ্ন বিশ্বের দরবারে দ্রুত জায়গা করে নিতে পারে! সে ক্ষেত্রে ভারত সরকারের মুখ পোড়া অনিবার্য।
৫) আবারও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে নেপাল-
কেপি শর্মা ওলি’র উপর প্রচন্ড যে পরিমাণ ক্ষিপ্ত তাতে তার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ মাওবাদীরা আবার হিংসার রাজনীতির পথে হাঁটতে পারেন বলে অনেকেরই ধারণা। এমনকি এই বিষয়টি চিন্তায় রেখেছে সে দেশের মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের ও নেপালি কংগ্রেসকেও। প্রচন্ড নেপালের রাজনীতির অভ্যন্তরে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন অন্য যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হন তিনি তাও মেনে নিতে পারবেন, কিন্তু কেপি শর্মা ওলি প্রধানমন্ত্রী হলে শান্তির পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত তাকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচন্ড যদি আবার সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে হাঁটেন তবে নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠবে নেপালের পরিস্থিতি।
প্রচন্ডকে ক্ষিপ্ত করে তোলার পিছনে অবশ্য ওলির অবদান কম নয়। তার বিরুদ্ধে বারবার উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মাধব কুমার নেপালের মত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের পরামর্শ কানে তোলেননি ওলি। তার ফলে প্রচন্ড যদি সশস্ত্র আন্দোলনের পথে হাঁটেন তার প্রভাব এসে পড়বে প্রতিবেশী ভারতেও। নতুন করে দেশের উত্তর সীমান্তে অস্থিরতা তৈরি হবে। এই পরিস্থিতি নয়াদিল্লির কাছে কোনও মতেই কাম্য নয়।