নিজস্ব সংবাদদাতা- পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট একেবারে সামনে এসে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশন এখনও ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা না করলেও একটি সূত্র মারফত শোনা যাচ্ছে এপ্রিল থেকে মে মাসের শেষ অব্দি ভোট প্রক্রিয়া চলবে। এই রাজ্যের জনগণের পাশাপাশি গোটা দেশের মানুষ এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। একাংশ মনে করছে বিজেপির ভারতব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ শেষ ধাপ। বাংলাকেও যদি গেরুয়া শিবির জয় করে নিতে পারে তবে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। হয়তো দেশের শাসন ব্যবস্থার সংস্কার সাধনও তারা করতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে আটকে দেবে বলে অনেকেই মত পোষণ করছেন। এই দুই পক্ষের মধ্যে প্রবলভাবে আছে বাম ও কংগ্রেস জোট।
২৯৪ আসনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গেলে কোন দল বা জোটকে ১৪৮ টি আসন পেতে হবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল একাই ২১১ টি আসনে জয়লাভ করেছিল। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের বিরোধী জোট ৭৭ টি আসনে জয় লাভ করে। কংগ্রেস এককভাবে ৪৪ টি আসন দখলে নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়। অন্যদিকে বামেদের ভোট শতাংশ অনেক বেশি থাকলেও তারা মাত্র ৩৩ টি আসনে জয়লাভ করে তিন নম্বর স্থানে নেমে যায়। বিজেপি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে জোট গঠন করে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। উভয়ই ৩ টি করে আসনে জয়লাভ করে। বিজেপি এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করতে সফল হয়েছিল।
২০১৯ এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি ১৮ টি আসন দখল করে বাম ও কংগ্রেস জোটকে বহু যোজন পিছনে ফেলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়। তৃণমূল ২২ টি আসনে জয়লাভ করে। দীর্ঘ ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট এই প্রথম লোকসভায় কোনো আসনে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয়। কংগ্রেস ২ টি আসনে জয়লাভ করে কোনোরকমে মুখ রক্ষা করতে পেরেছিল।
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রাখতে সফল হবেন নাকি নরেন্দ্র মোদির বিজেপি প্রথমবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসবে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহল বেশ সরগরম। একটি পক্ষ বলছে এই দুই পক্ষকে পরাজিত করে বাম-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় আসলে রাজ্যের ভালো হবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাস ধরে বারবার পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন অমিত শাহ, জেপি নাড্ডার মতো শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এর মধ্যে সরকারি ও দলীয় কর্মসূচি ঘিরে বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন।
এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট দাবি করছে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে হলে তৃণমূল কখনোই বিকল্প হতে পারে না। তাদের মতে যারা আজ তৃণমূল তারাই কাল বিজেপি হয়ে যাবে, এই ঘটনা প্রমাণিত। পাশাপাশি তারা রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসংখ্য দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে। জোটের বক্তব্য গত ১০ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় থেকেও শিল্প স্থাপন করতে না পেরে এবং একের পর এক সরকারি পদ তুলে দিয়ে রাজ্য সরকার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে। প্রতিশ্রুতি হিসেবে বাম কংগ্রেস জোট জানিয়েছে তারা রাজ্যে ক্ষমতায় আসলেই শিল্প স্থাপনের জোয়ার বইয়ে দেবে। এর পাশাপাশি তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দলকে রাজ্য ছাড়া করে ছাড়বে বলেও জানিয়েছে।
কেন্দ্রের শাসক দল এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসা বিজেপির বক্তব্য বামেদের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে এবং তৃণমূলের গত ১০ বছরের শাসনে এ রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিজেপি সাম্প্রদায়িক তাস খেলে বাজিমাত করতে চাইছে। পাশাপাশি তারা সিএএ-এনআরসি ইস্যু উত্থাপন করে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ এনে বিজেপি প্রচার করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের বাকি রাজ্যগুলির তুলনায় ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। তারা এই প্রসঙ্গে বারবার গুজরাট মডেলের কথা উত্থাপন করছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাঙালি ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি করার অভিযোগও করছে গেরুয়া শিবির।
পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল এর বক্তব্য দীর্ঘ ৩৪ বছর বাম শাসনের পর গত ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার রাজ্যের প্রভূত উন্নতি করেছে। পাশাপাশি এই সরকার অজস্র জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েছে বলেও তারা বারবার দাবি করছে। দুয়ারে দুয়ারে সরকার ও স্বাস্থ্য সাথী কার্ডকে তুরুপের তাস বানাতে চাইছে তৃণমূল। পাশাপাশি তারা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করার অভিযোগ তুলছে। সেই সঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বহিরাগত রূপে চিহ্নিত করে বাঙালি ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। বাম-কংগ্রেস জোটকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে রাজ্যের শাসক দলের বক্তব্য বিজেপির সুবিধা করে দিতেই ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে বাম-কংগ্রেস জোট নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার রাজনীতি করার অভিযোগ তুলেছে তারা।
এই ভোটের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে চলেছে তৃণমূল ত্যাগী নেতারা। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বেশকিছু শীর্ষ স্থানীয় তৃণমূল নেতারা দলত্যাগ করে গেরুয়া শিবিরে সামিল হয়েছেন।
এই মুহূর্তে দেশব্যাপী যে কৃষক আন্দোলন চলছে তার সরাসরি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে খুব বিশাল না পড়লেও বামেরাই মূলত কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য হান্নান মোল্লার উদ্যোগেই মূলত সংযুক্ত কিষান সংঘর্ষ কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির নেতৃত্বেই কৃষক আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের একটা অ্যাডভান্টেজ বামেরা পাবে। উল্টোদিকে তৃণমূল কৃষক আন্দোলনের ভাগ বামেদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ক্রমশ ক্ষীয়মান হলেও এ রাজ্যে তাদের বেশ কিছু পকেট ভোট আছে। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলায় আজও কংগ্রেস প্রধান ফ্যাক্টর। এই বছর পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আরও চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ক্রমশ সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ বিহারে খারাপ ফলাফলের পর পশ্চিমবঙ্গেও যদি তারা খারাপ ফল করে তবে গোটা দেশেই কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা বিরোধী শিবিরের কাছে অনেকটাই কমে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতে চলেছে প্রধান দলগুলির জোট চরিত্র। তৃণমূল মূলত এককভাবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে সঙ্গে পেয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দুটি শিবিরকেই। বিনয় তামাং নেতৃত্বাধীন শিবির আগে থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে ছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সমর্থন করলেও বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বাধীন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শিবিরটি বিজেপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে এবারের নির্বাচনে তৃণমূলকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছে। এর পাশাপাশি শারদ পাওয়ারের এনসিপি, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টির মতো দলগুলি তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনী ময়দানে নামতে পারে।
বিজেপি কোনো বড় শরিককে সঙ্গে না নিলেও তারা বেশ কিছু ছোট ছোট দলের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই দার্জিলিং পাহাড়ের আরেকটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল জিএনএলএফের সমর্থন নিশ্চিত করেছে দিলীপ ঘোষরা। এর পাশাপাশি গত সপ্তাহে অমিত শাহ রাজবংশী নেতা অনন্ত রায়ের সঙ্গে বৈঠক করার পর তার নেতৃত্বাধীন দল কামতাপুর পিপলস পার্টির সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। তবে বিজেপির অন্যতম বড় ভরসা মতুয়াদের সমর্থন। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটি এ রাজ্যের ৩০ বিধানসভা কেন্দ্রের জয় পরাজয় নির্ধারণ করে। লোকসভা নির্বাচনের সময়ে মতুয়াদের সমর্থন বিজেপির দিকে যাওয়ায় তারা অভূতপূর্ব ভালো ফলাফল করেছিল।
রাজ্যের তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসা বাম-কংগ্রেস জোট সবচেয়ে বড় মাস্টার স্ট্রোক দিতে চলেছে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোট গড়ে। এর পাশাপাশি আরো দু-একটি ছোট ছোট রাজনৈতিক দল বাম কংগ্রেস জোটে শামিল হতে পারে। তবে বামেদের অন্যতম বড় ব্যর্থতা হয়ে দেখা দিতে চলেছে বামপন্থী দল সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের আলাদা ভাবে নির্বাচনে লড়াই করা। এসইউসি (কমিউনিস্ট) দলটিও পৃথকভাবে নির্বাচনে লড়ার কথা জানিয়েছে।
ঝাড়খণ্ডের শাসকদল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা জঙ্গলমহল অঞ্চলে প্রার্থী দেওয়ার কথা জানিয়েছে। বিহার নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া হায়দ্রাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন মিম এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দেবে বলেও ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, মিমের মতো দলগুলি বড় কোনো জোটের সামিল না হলেও তারা বেশকিছু বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফল যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে পারে।
তপশিলি জাতি ও উপজাতি প্রধান কেন্দ্রগুলি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা।
গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে যেমন একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছিল বিজেপি তেমনি জঙ্গলমহলের দখল নিয়েছিল তারা। তবে দক্ষিণবঙ্গে আগের মতোই প্রায় একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এবারে দেখার এই সমীকরণ একই রকম থাকে নাকি ভোটের সময় গোটা ঘটনা পাল্টে যায়। এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বামেরা ক্রমশই সক্রিয় হয়ে উঠছে। একটা বড় অংশের মানুষ যারা বামেদের পাশ থেকে সরে গিয়ে বিজেপির দিকে গিয়েছিল তারা অনেকেই আবার বামেদের পক্ষে ফিরে আসছেন বলে মনে হয়। সেই সঙ্গে তৃণমূলের পক্ষে হাওয়া খুব একটা সুবিধার নয়। এই অবস্থায় তৃণমূল ও বিজেপির দ্বিমেরু সমীকরণের বাইরে গিয়ে বাম-কংগ্রেস জোট অভূতপূর্ব ভালো ফলাফল করে সবাইকে চমকে দিতে পারে।
এটুকু বলা যায় শেষ পর্যন্ত ফলাফল কি হবে তার জন্য জনতা জনার্দনের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনতাই শেষ কথা বলে।