পশ্চিমবঙ্গের ভোট পর্ব শুরু হয়ে তা হাঁটি হাঁটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দফার পর ১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফার ভোট। এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে ততক্ষণে দ্বিতীয় দফার ভোট পর্ব শুরু হয় গিয়েছে। এই দফাতেও ৩০ টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ প্রথম দুটি দফা মিলিয়ে রাজ্যের ৬০ টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিতীয় দফাতেই যে রাজ্যের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ কেন্দ্র নন্দীগ্রামে নির্বাচন হচ্ছে তা সবার জানা। অনেকেই বলছেন নন্দীগ্রাম নির্ধারণ করবে আগামী দিনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কে হবে। বিষয়টি যেমন একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়, তেমনি এটা অনেক যদি কিন্তুর ওপর নির্ভর করছে। তবে দ্বিতীয় দফার ভোটের মধ্যেই নবান্নের প্রবেশ পথে পা রাখার চাবিকাঠি যে অনেকটাই লুকিয়ে আছে তা বলা যায়।
দ্বিতীয় দফার ভোটে ৩০ টি আসনে ভোটগ্রহণ হবে সেখানে রাজ্যের মোট বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যা ২৯৪। তাই সরাসরি এটা বলা সম্ভব নয় যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেই নবান্নে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমীকরণ বিশ্লেষণ করে এটুকু বলাই যাই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে যে কেন্দ্রগুলোতে ভোট হচ্ছে তাদের ফলাফল অনেকটাই নির্ধারণ করে দেবে কে আগামী দিনে বাংলায় সরকার গড়বে।
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের কেন্দ্রগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে। এরমধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার যে ৯ টি কেন্দ্রে এই দফায় ভোট হবে তার সবগুলোতেই গত লোকসভা নির্বাচনে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তৃণমূলের। আবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জেলার যে ৯ টি কেন্দ্রে ভোট হতে চলেছে সেগুলিতে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ঘাঁটিতে থাবা বসিয়েছিল বিজেপি। আবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার যে চারটি কেন্দ্রে নির্বাচন হবে এই দফায় সেগুলিতে ২০১৬ এর বিধানসভা ভোটের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই উনিশের লোকসভা নির্বাচনেও সমান প্রভাব ধরে রেখেছিল তৃণমূল। মজার বিষয় হল এই নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উঠে আসা সংযুক্ত মোর্চা ২০১৯য়এর লোকসভা নির্বাচনে এই ৩০ টি কেন্দ্রের একটিতেও এগিয়ে ছিল না। যদিও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, হলদিয়া, পাঁশকুড়া পূর্ব বা বাঁকুড়া জেলার বড়জোরা, বাঁকুড়ার মত বিধানসভা কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত মোর্চার বিভিন্ন শরিক দল জয়লাভ করে।
নবান্নের চাবিকাঠি এই দ্বিতীয় দফায় ঠিক কতটা লুকিয়ে আছে তা এবার বরং বিশ্লেষণ করে দেখে নেওয়া যাক। এক্ষেত্রে আমরা এক একটি পক্ষ ধরে আলোচনা করব।
এই দফায় তৃণমূলের হিসেব-নিকেশ-
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকার গঠন করেছিল তৃণমূল। তাদের সেই একাধিপত্য ব্যাপকভাবে ধাক্কা খায় ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে। এটুকু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে অনেক মেরামতের পরেও উত্তরবঙ্গ ঘাসফুল শিবিরের কাছে বেশ নড়বড়ে জায়গা। তাই আবার নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রবেশ করতে হলে দক্ষিণবঙ্গের পুরানো ঘাঁটিগুলোতে কেবলমাত্র আধিপত্য ধরে রাখলে হবে না তাকে আরও জোরদার করে তুলতে হবে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূলের ফল কেমন হচ্ছে তার ওপর নবান্নে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে। কারণ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ও অত্যন্ত ভালো ফল করে তৃণমূল। যদিও শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে চলে যাওয়ার ফলে এই জেলায় তৃণমূলের দলীয় সাংগঠনিক শক্তি প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব মেদিনীপুরে ‘শুভেন্দু ক্ষত’ কতটা সামলাতে পারল তৃণমূল তার ওপর নবান্ন দখলের বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করবে।
পূর্ব মেদিনীপুরের মতো প্রায় একই রকম কথা খাটে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রে। এই জেলায় গত লোকসভা নির্বাচনে ভালোমতোই প্রভাব বিস্তার করেছে বিজেপি। এই নির্বাচনে সেই ধাক্কা তারা কতটা সামলাতে পারল তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আবার বাঁকুড়া জেলার বিধানসভা কেন্দ্রগুলোতে বিজেপির আধিপত্য লোকসভা নির্বাচনেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। নবান্ন দখলে রাখতে গেলে তৃণমূলকে আগের থেকে কিছুটা হলেও অন্তত ভালো ফলাফল করতে হবে এখানে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা বরাবরই তৃণমূলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে এই দফায় যে চারটে বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হচ্ছে গত লোকসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্রগুলোতে এগিয়ে তৃণমূল। একটা বিষয় পরিষ্কার আবার নবান্নে ফিরতে হলে তৃণমূলকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পুরানো আধিপত্য ধরে রাখতে হবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে ভালো ফল করা ছাড়া জোড়া ফুল শিবিরের কাছে দ্বিতীয় কোনও সুযোগ নেই।
বিজেপির জটিল সমীকরণ-
নবান্ন দখল করতে হলে উত্তরবঙ্গ থেকে নেমে এসে দক্ষিণবঙ্গে গেরুয়া শিবিরকে ভালো ফল করতেই হবে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া জেলায় একচেটিয়া ভালো ফল করে বিজেপি। এবারেও সেই ফলাফল ধরে রাখার পাশাপাশি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় তারা যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল তা আরও খানিকটা ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা শুভেন্দু অধিকারী দলে চলে আসার পর বিজেপি আশা করছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তারা তৃণমূলকে পিছনে ফেলে প্রধান দল হিসেবে উঠে আসবে। নবান্ন দখল করতে হলে গেরুয়া শিবিরের কাছে এই সমীকরণ মিলে যাওয়াটা খুব জরুরী।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় তৃণমূলের ঘাঁটিতে থাবা বসাতে হবে বিজেপিকে। না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের বেশ কিছুটা আগেই তাদের দৌড় থেমে যেতে পারে। সে অনুযায়ী এই জেলার যে চারটি কেন্দ্রে দ্বিতীয় দফায় ভোট হচ্ছে সেগুলোতে ভালো ফলাফল করার জরুরি বিজেপির। যদিও এই অঞ্চলে বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি বা সমর্থন যথেষ্ট কম।
সংযুক্ত মোর্চার স্বপ্ন-আশা
দ্বিতীয় দফায় যে বিধানসভা কেন্দ্রগুলোতে ভোট হচ্ছে সেই জায়গায় সংযুক্ত মোর্চার তিন প্রধান শরিক কংগ্রেস-বামফ্রন্ট এবং আইএসএফের সাংগঠনিক শক্তি বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত। যদিও বামফ্রন্টের মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ এলাকায় ফিরে যাওয়ার পর পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশে ভালো ফলাফলের স্বপ্ন দেখছে লাল ঝান্ডা। একই রকমভাবে বাঁকুড়া জেলায় তৃণমূল-বিজেপিকে পিছনে ফেলে আগের জায়গায় ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় জান-প্রাণ লড়িয়ে দিয়েছে কংগ্রেস ও সিপিআই(এম)। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে বাঁকুড়ার দু’চারটে আসনে কংগ্রেস এবং বামেরা ভালো ফল করলেও সার্বিকভাবে জেলার দখল নেওয়া সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে যথেষ্ট কঠিন।
তৃণমূল এবং বিজিপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাঝে বামেরা যদি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তাদের গতবারের জেতা তিনটি আসন ধরে রাখতে পারে তাহলে সেটাই অনেক বড় ব্যাপার হবে। যদিও নবান্ন দখল করতে হলে সংযুক্ত মোর্চাকে এই জেলায় যথেষ্ট ভালো ফল করতে হবে। একই রকমভাবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার যে চারটি বিধানসভা আসনের ভোট হচ্ছে সেখানেও বামেদের ভালো ফলাফল করাটা জরুরি। তবে এই অঞ্চলে তৃণমূলকে পরাস্ত করা বেশ কঠিন। সেদিক থেকে বলা যায় নবান্ন দখল করার বিষয়ে দ্বিতীয় দফার ভোট সংযুক্ত মোর্চাকে খুব একটা আশার আলো দেখাতে পারবে না।