বছরের শেষ দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল এই রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। বিশেষত বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে বিধানসভায় তৃণমূল সরকার তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিক। গতকাল বিধানসভায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান এবং বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলনেতা সিপিআই(এম)’র সুজন চক্রবর্তী এই দাবি তোলেন। তাদের বক্তব্য যেভাবে তৃণমূল থেকে একের পর এক বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে এবং রাজ্যের মন্ত্রী ও অন্যান্য তৃণমূল বিধায়করাও দলে থেকেই দলের তীব্র সমালোচনা করে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করছে তাতে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে রাজ্যবাসীর মনে। এই সংশয় দূর করতেই তৃণমূলের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ দেওয়া উচিত বলে দাবি করেন এই দুই বিরোধী নেতা।

20210101 083859

রাজ্য সরকার নিজে থেকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ না দিলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে বলে জানানো হয়েছে কংগ্রেস এবং বামেদের পক্ষ থেকে। এমনকি শোনা যাচ্ছে বিজেপিও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার তোড়জোড় শুরু করেছে। বিজেপি যদি অনাস্থা প্রস্তাব আনে সে ক্ষেত্রে তারা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন? এই প্রশ্ন করা হলে আব্দুল মান্নান এবং সুজন চক্রবর্তী একযোগে জানান, “আমরা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেব। কারণ এই সরকারের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। তাতে আর কারা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবে তা নিয়েও আমাদের মাথা ব্যাথা নেই।”

একদল সাংবাদিক প্রশ্ন করেন সে ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের পক্ষ থেকে বাম ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি সখ্যতার অভিযোগ তোলা সহজ হয়ে যাবে কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাম ও কংগ্রেসের এই দুই নেতা বলেন রাজ্যের মানুষ এতো বোকা নয় যে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিলেই বিজেপি সখ্যতার দাবি তারা মেনে নেবে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গে সখ্যতার দাবিও মেনে নিতে হয় বলে মন্তব্য করেন তারা। এই বিষয়ে সুজন চক্রবর্তী বলেন, “এর আগে কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরোধিতা করে বিধানসভায় সরকারের আনা প্রস্তাবে আমরা সমর্থন জানিয়েছি। কই তখন তো আমাদের বিরুদ্ধে তৃণমূল সখ্যতার অভিযোগ ওঠেনি!”

20210101 083819
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান দাবি করেন কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রস্তাব আনেন তখন সেই প্রস্তাবে কংগ্রেস এবং বাম দলগুলি সমর্থন জানিয়েছিল, তারপরও যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে তৃণমূল সখ্যতা নিয়ে বিজেপির আনা অভিযোগ রাজ্যবাসী বিশ্বাস করেনি, তাই এক্ষেত্রেও তৃণমূল তাদের বিরুদ্ধে বিজেপি ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুললেও তা রাজ্যের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনটা সরকারের বিরোধিতা আর কোনটা ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমবঙ্গবাসী তা ভালোভাবেই বোঝেন বলে মন্তব্য করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। এই প্রসঙ্গে তিনি কটাক্ষ করে বলেন, “বিজেপি ঘনিষ্ঠতা আসলে কি তা সবচেয়ে ভালো তৃণমূল বোঝে, ওরা তো দীর্ঘদিন বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছে!”

প্রসঙ্গত অনেক তৃণমূল বিধায়ক ইতিমধ্যেই দলত্যাগ করে বিজেপি শিবিরে সামিল হয়েছে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে জানুয়ারি মাসের মধ্যে আরো প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন তৃণমূল বিধায়ক গেরুয়া শিবিরের সামিল হতে পারে। অবশ্য এর আগেই মুকুল রায় দাবি করেছিলেন তার সঙ্গে শতাধিক তৃণমূল বিধায়ক প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, তারা যে কোনো মুহূর্তে বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়ের মতো শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতারা একাধিকবার মমতা সরকার ফেলে দেবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

শাসকদলের বিধায়ক ভাঙিয়ে নিজেদের সরকার গড়ার বিষয়টি অবশ্য বিজেপির কাছে নতুন নয়। সাম্প্রতিক অতীতে কর্ণাটক এবং মধ্যপ্রদেশ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। রাজ্যের রাজনৈতিক মহল মনে করছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই নীতি নিয়ে চলেছেন অমিত শাহরা। বিধানসভা ভোটের আগেই বড় সংখ্যক তৃণমূল বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে তারা রাজ্য সরকার ফেলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিধানসভা ভোট হবে রাষ্ট্রপতি শাসনে, যা বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের সমান।

পরিসংখ্যানের দিকে নজর রাখলে বাস্তব পরিস্থিতিটা অবশ্য একটু জটিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পতন ঘটাতে গেলে কমপক্ষে ৬০ জন বিধায়ককে ভাঙিয়ে আনতে হবে গেরুয়া শিবিরে, তা অসম্ভব না হলেও খানিকটা কঠিন কাজ তো বটেই। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন সরকার বাঁচাতে তৃণমূল নেত্রীর উচিত নিজে থেকেই দ্রুত বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেওয়া। কারণ বিধানসভায় একবার যদি আস্থা ভোট বা অনাস্থা ভোটে রাজ্যের শাসক দল জয় লাভ করে তাহলে আগামী ছয় মাস অন্তত বিরোধীরা কোনো অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারবে না। এক্ষেত্রে দ্রুত আস্থা ভোট করিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ দিতে পারলে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার নিশ্চিন্ত থাকবে।

রাজ্য,
বিজেপির পরিষদীয় দলনেতা মনোজ টিগ্গা

রাজ্য বিধানসভার অনাস্থা ভোট নিয়ে বিজেপির পক্ষ থেকে অবশ্য এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানানো হয়নি। তাদের পরিষদীয় দলনেতা মনোজ টিগ্গা এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা বিধানসভায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনব কিনা তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা করতে হবে।” এই বিজেপি নেতা কংগ্রেস ও বামেদের অনাস্থা প্রস্তাবের দাবি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব যদি শেষ পর্যন্ত আনা হয় তাতে আখেরে তৃণমূলের ফায়দা হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ তৃণমূল প্রচার করার সুযোগ পেয়ে যাবে মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও কাজের সময় তাদের সঙ্গেই হাত মেলায় কংগ্রেস ও বামেরা! যদিও তাদের এই দাবি আদৌ মানুষকে কতটা প্রভাবিত করবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। উল্টো দিকে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে নতুন বছরের শুরুতেই বাম ও কংগ্রেস জোট তাদের তৃণমূল বিরোধী ভাবমূর্তি সুস্পষ্ট করে রাজ্যের ভোটারদের একাংশকেও স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে।