কাশ্মীর থেকে কেরল, গুজরাত থেকে বঙ্গ – সব রাজ্যেই তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। সাংবিধানিক সম্মান থেকে কোটি কোটি টাকার বাজেট। সবকিছুই বরাদ্দ তাঁদের জন্য। সেপাই, সান্ত্রী, খানসামা বাবুর্চি থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিলাসবহুল প্রাসাদ রাজভবন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বিতর্ক পিছু ছাড়ে কই। কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগ রাজ্যপালের চিরসঙ্গী। গুরুত্বেও বাড়ির মেজ দিদার মতো। সম্মানে সবার বড়। কিন্তু কথা শোনে না কেউই। দু-একটি মন্তব্য করে আসর গরম করতে পারেন মাত্র। অর্থাৎ বিতর্ক বাঁধানো পর্যন্তই তাঁর ক্ষমতা। সমস্যা সমাধানের জাদুকাঠি তাঁর হাতে নেই।
পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই কংগ্রেস আমল থেকে এখনও পর্যন্ত ২৮ জন রাজ্যপাল দেখেছে বঙ্গের মানুষ। কেউ রাজ্য সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ন সহাবস্থানে বিশ্বাসী। কেউ আবার খড়্গহস্ত। সারাক্ষণ তোপ দেগেই চলেছেন। এখানে আমরা সেই রকম ৫ জন বিতর্কিত রাজ্যপালের সম্পর্কে আলোচনা করলাম। যারা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রীতি মতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
১। রাজ্যপাল ধরমবীর – ১৯৬৭ সালে বাংলা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়ের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে হইচই ফেলে দেন রাজ্যপাল ধরমবীর। অবশ্য ১৯৬৯ সালে ফের ক্ষমতায় আসে সেই যুক্তফ্রন্ট। প্রথা অনুযায়ী, রাজ্যপাল কিংবা রাষ্ট্রপতি সরকারের তৈরি করে দেওয়া লিখিত ভাষণই বিধানসভায় বা লোকসভায় পাঠ করেন। ১৯৬৯ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের পর, বিধানসভায় পাঠ করার জন্য তাঁকে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিল সরকার। সেই বিবৃতিতে লেখা ছিল, ‘আমি প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার অন্যায়ভাবে ভেঙেছিলাম’। রাজ্যপাল ওই অংশটুকু বাদ দিয়েই লিখিত ভাষণ পাঠ করেন। যুক্তফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রীরা বারবার দাবি করা সত্ত্বেও, ধরমবীর ওই অংশ পাঠ করেননি। ওই সময় নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের বিরোধ শুরু হয়। পরে রাজ্য সরকারের চাপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ধরমবীরকে সরিয়ে এস এস ধাওয়ানকে বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠান।
২। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী – ২০০৭ সালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন শেষ বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে তুমুল বিরোধ হয় রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর। ওই বছরের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশ অভিযানে ১৪ জনের মৃত্যুর পর ‘হাড় হিম করা আতঙ্ক’ বলে লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলেন তিনি। রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই গোপালকৃষ্ণ ওইসব উপদ্রুত এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, যা বুদ্ধবাবুরা ভালোভাবে নেননি। সিঙ্গুর বিতর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ধর্মতলায় অনশন করছেন, তখন গোপালকৃষ্ণ সেই অনশন মঞ্চে গিয়েও বিতর্কে ইন্ধন দেন। বুদ্ধবাবু তাঁর ‘ফিরে দেখা’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে গোপালকৃষ্ণের ভূমিকার সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘আমিই তাঁকে রাজ্যপাল করে নিয়ে এসেছিলাম।’
৩। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন – মমতার নেতৃত্বে ‘পরিবর্তনের সরকার’ শপথ নিয়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু মহাকরণে চিঠি লিখে তাঁকে বলতে হয়েছে, সরকারের কাছে রাজভবন কোনও কিছু জানতে চাইলে জবাব দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। জবাব যা আসে, তা-ও অনেক সময় দায়সারা। গুন্ডাগিরি নিয়ে মুখ খোলার পরে তাঁকে ‘লাল কার্ড’ দেখার হুমকিও শুনতে হয়েছে। তবে অবস্থা চরমে পৌঁছয় খিদিরপুরে একটি কলেজের গোলমালে কলকাতা পুলিশের এক এসআই তাপস চৌধুরির মৃত্যুকে ঘিরে। ওই ইস্যুতে মমতার নির্দেশে সরতে হয় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দাকে। রাজ্যপাল ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তোপে পড়েন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের।
৪। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী – বসিরহাট, বাদুড়িয়া, দেগঙ্গার সাম্প্রদায়িক গোলমাল নিয়ে তৃণমূল সরকারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেঁধেছে বারবার। তিনি রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনা করায় মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, রাজ্যপাল তাঁকে অপমান করেছেন। রাজভবন ছাড়ার দিন সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্যটি করেন ত্রিপাঠী। তিনি বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোষণের রাজনীতিতেই এ রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে৷ আমার মনে হয়, বৈষম্য ছাড়া প্রত্যেক নাগরিককেই তাঁর সমান ভাবে দেখা উচিত৷’
৫। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় – একেবারে প্রথম থেকেই ধনকড় একের পর এক বিতর্কিত কথাবার্তা বলে রাজ্য সরকারকে বিপাকে ফেলছেন। যাদবপুরের ছাত্র বিক্ষোভ থেকে শুরু করে হালে ফোনে আড়িপাতা এবং চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় ‘অপমানিত’ বোধ করে তিনি মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এমনকী বিধানসভায় তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলেও শোরগোল ফেলে দিয়েছেন ধনকড়।