তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর শুভেন্দু অধিকারী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে দল বিরোধী কথা না বললেও অরাজনৈতিক ব্যানারে একের পর এক সভা-সমাবেশ রাজ্যজুড়ে করে চলেছেন। যা থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে দলের সঙ্গে তার দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত তিনি দল ছাড়েননি বা মমতা ব্যানার্জি সম্বন্ধে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। সম্ভবত দলের সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গেলেও দল ছাড়া নিয়ে এই মুহূর্তে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন শুভেন্দু।
স্বাভাবিকভাবেই এই মুহূর্তে দল ছাড়া নিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেব-নিকেশ কষায় ব্যস্ত তিনি। কারণ তৃণমূলে তিনি যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন দল পরিবর্তন করে বিজেপিতে যোগ দিলে সেগুলো একইরকম ভাবে পাওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ তাকে করতেই হবে। যদি তিনি বিজেপিতে যাওয়ার কথা ভেবেও থাকেন সে ক্ষেত্রে তাকে মাথায় রাখতে হবে বিজেপি একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল। তাই তৃণমূলে যেভাবে তিনি চলাফেরা করতে পারতেন তার অনেক কিছুই হয়তো বিজেপিতে গেলে সম্ভব হবে না। শুভেন্দু অধিকারী তার মতো করে হিসাব করুন , আমরা বরং আলোচনা করে দেখি তৃণমূলে থাকার কোন কোন সুবিধাগুলো তাকে হারাতে হবে যদি বিজেপিতে যোগদান করেন।
১) স্বাধীনতার ওপর লাগাম পড়বে
তৃণমূল হলো কংগ্রেসী ঘরানার রাজনৈতিক দল। ফলে এই দলের নেতাদের কাজকর্ম এবং চলাফেরায় অনেক বেশি স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু বিজেপি রেজিমেন্টেড পার্টি হওয়ায় নেতা ও কর্মীদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকে। তাই তারা চাইলেই যেকোনো অরাজনৈতিক সংগঠনেরসঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না। তার জন্য দলের অনুমতির প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন কংগ্রেসে ঘরানার রাজনীতি করে সে এখন হঠাৎ করে নিজের স্বাধীনতা বর্জন করা খুব একটা সহজ হবে নাম শুভেন্দু বাবুর পক্ষে।
২) স্থানীয় স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারাতে হবে
স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে বিশেষত পঞ্চায়েত, পৌরসভা নির্বাচনের মতো বিষয়গুলিতে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশ, বাঁকুড়ার একাংশ এবং মুর্শিদাবাদে কাদের প্রার্থী করা হবে সেই সিদ্ধান্ত অনেকটাই একা নিতেন শুভেন্দু। তার ফলে তার অনুগামীদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বসানো তার পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু বিজেপিতে গেলে এই সুযোগ তিনি মোটেও পাবেন না। বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব প্রার্থী নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে অনুগামীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে শুভেন্দু অধিকারীর।
৩) নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে না
শুভেন্দু অধিকারী এই মুহূর্তে তৃণমূলের সর্বোচ্চ কোর কমিটির অন্যতম সদস্য। এই কমিটির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বিজেপিতে গিয়ে যত বড় পদই পান না কেন নীতি নির্ধারণের সুযোগ তার থাকবে না। কারণ বিজেপির নীতি নির্ধারন করা হয় দলের সংসদীয় কমিটির দ্বারা। আর এই কমিটির সদস্য হওয়া শুভেন্দুর পক্ষে সম্ভব হবে না তা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়াই যায়।
৪) মাথার ওপর থাকবে একাধিক নেতা
তৃণমূলে মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে কাজ করতে হয় শুভেন্দু অধিকারীকে। অন্যদিকে বিজেপিতে গেলে এই সুযোগ আর পাবেন না তিনি। রাজ্যস্তরে তার মাথার ওপর থাকবে একাধিক বিজেপি নেতা। কেবলমাত্র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নন, সেইসঙ্গে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়, দলের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, অরবিন্দ মেনন, শিবপ্রকাশদের মতো নেতাদের অধীনে কাজ করতে হবে তাকে। রাজ্যস্তরে তার মাথার ওপর এতজন নেতার উপস্থিতি সম্ভবত তাকে খুব একটা সচ্ছন্দে রাখবে না।
৫) সংখ্যালঘু সমর্থন ভিত্তি হারাতে হবে
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তি শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী ও সমর্থকদের মধ্যে একটা বড় অংশই হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তিনি বিজেপিতে যোগদান করলে খুব সম্ভবত এই অনুগামীরা তার সঙ্গ ত্যাগ করবে।
৬) অধিকারী পরিবারের একাধিপত্য চলে যাবে
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রাজনীতিতে তৃণমূলের অভ্যন্তরে অধিকারী পরিবার একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু তিনি বিজেপিতে গেলে তা আর কোনভাবেই বজায় থাকবে না। কারণ বিজেপির মতো একটি সংগঠন ভিত্তিক দল কখনই একটি পরিবারের হাতে জেলার সমস্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করতে সহমত হবে না বলে ধরে নেওয়াই যায়।
৭) আন্তরিকতার অভাব ঘটতে পারে
তৃণমূল কংগ্রেসে শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা একটি ঘরোয়া পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পান। তার ফলে দলের কাছ থেকে প্রত্যাক্ষাত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। কিন্তু বিজেপির মত সংগঠন ভিত্তিক একটি সর্বভারতীয় দল তাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে পরে ভুলে যেতেই পারে। আর যদি এরকম ঘটনা একবার ঘটে তাহলে আবার বর্তমান জায়গায় ফিরে আসা তার পক্ষে প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।
৮) বিধায়ক পদ চলে যাবে
এই মুহূর্তে তিনি যদি তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করেন তাহলে দলত্যাগ বিরোধী আইনে তার বিধায়ক পদ খারিজ হয়ে যেতে পারে।
আঞ্চলিক দলের রাজনীতি করে যে নেতারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তাদের পক্ষে কোনো একটি সর্বভারতীয় দলে গিয়ে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন। তার ওপর সেই দল যদি হয় বিজেপির মত রেজিমেন্টেড, সে ক্ষেত্রে একসময় অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকেন এই নেতারা।