প্রথম দফার ভোট ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। কোন রাজনৈতিক পক্ষ এই দুই দফার ৬০ টি আসনের মধ্যে কতগুলি করে নিজেরা পাবে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট চাপানউতোর তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের মত করে ভালো ফলাফলের দাবি জানাচ্ছে। এই দাবি অবশ্য খুব স্বাভাবিক। কারণ বাকি ছয় দফায় আরও ২৩৪ টি আসনের নির্বাচন বাকি আছে। তাই নিচু তলার কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করে যতটা ভালো সম্ভব ফলাফল করে নেওয়াই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য।

আগামী ৬ এপ্রিল তৃতীয় দফার বিধানসভা ভোট। এই পর্যায়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলিতে নির্বাচন হবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের ফল অনুযায়ী তৃতীয় দফায় নির্বাচন হতে চলা ৩০ টি কেন্দ্রে একচেটিয়া ভালো ফল করেছিল তৃণমূল। মাত্র ৩ টি কেন্দ্র দখলে রাখতে পেরেছিল বিরোধীরা। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফল অনুযায়ী এই দফার কেন্দ্রগুলোতেও একচেটিয়া ভালো ফল করে তৃণমূল। কেবলমাত্র হুগলি জেলার কেন্দ্রগুলিতে তারা কিছুটা হলেও তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর নিতে পেরেছে। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় তৃতীয় দফায় এ রাজ্যের বিরোধীপক্ষগুলি তৃণমূলের গড়ে প্রবেশ করছে।

নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ’রা পশ্চিমবঙ্গ দখলের লক্ষ্যে প্রায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করেছেন, অন্তত তৃণমূলের পক্ষ থেকে সে রকমই দাবি করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে হলে বিজেপিকে তৃতীয় দফার ভোট থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কারণ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনও প্রমাণ করে দিয়েছে উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে তৃণমূলের ভিত কিছুটা দুর্বল হলেও দক্ষিণবঙ্গ এখনও তাদের শক্ত ঘাঁটি। কিছুটা ভুল হল বলা উচিত দক্ষিণবঙ্গে বিরোধীদের অস্তিত্ব প্রায় নেই। আগামী ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ দফার নির্বাচন হবে। এই দফাতেও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বিজেপি। কারণ চতুর্থ দফায় নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রথম উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করবে। কোচবিহারের যে কেন্দ্রগুলিতে চতুর্থ দফায় ভোট হবে সেখানে অবশ্যই বিজেপি কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে। কিন্তু তৃতীয় দফার মতোই দক্ষিণবঙ্গের কেন্দ্রগুলিতে আবারও অ্যাডভান্টেজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল।

সহজ করে বললে বলতে হয় এবারে বিজেপি আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাস তালুকে প্রবেশ করছে। এই পর্যায়ে ভালো ফল করতে হলে ‘বাংলার অগ্নিকন্যা’ মমতাকে হতাশ করে তুলতে হবে গেরুয়া শিবিরের। এখনও পর্যন্ত যা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। আমরা বরং দেখি তৃতীয় দফার নির্বাচনে ঠিক কি কি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে চলেছে গেরুয়া শিবির।


[  ] তৃণমূলের দুর্ভেদ্য সংগঠন-

তৃতীয় দফায় রাজ্যের যে বিধানসভা কেন্দ্র গুলোতে নির্বাচন হবে তার একাংশ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত। এই জেলার সাংসদ যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনিতেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা বরাবরই তৃণমূলের গড় হিসেবে পরিচিত। তৃণমূল নেত্রীর নিজের বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার পাশাপাশি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া হুগলির মত জেলাগুলোর সংগঠন তিনি একরকম নিজের হাতে তৈরি করেছেন। এই অঞ্চলে তৃণমূলের সঙ্গে সাংগঠনিক শক্তি পাল্লা দেওয়া বিরোধীদের দুঃসাধ্য। শত চেষ্টা করেও তারা এখানে সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ভালো ফল করতে গেলে সাংগঠনিক শক্তি যে অপরিহার্য তার প্রমাণ অতীতে একাধিকবার পাওয়া গিয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এই অঞ্চলে লড়াই শুরু করার আগেই কিছুটা পিছিয়ে আছে গেরুয়া শিবির।


[  ] প্রধান বিরোধী নয়-

ভোটারদের জন্য আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য আমরা হাজির করছি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় এখনও পর্যন্ত বিজেপি প্রধান বিরোধী শক্তি নয়। এই জেলায় তৃণমূলের সঙ্গে যেটুকু লড়াই করা সম্ভব হচ্ছে তা করছে কেবলমাত্র সংযুক্ত মোর্চা। এখানকার সংখ্যালঘু প্রভাবিত কেন্দ্রগুলিতে আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে বামেরা কিছুটা হলেও পাল্টা লড়াই ফিরিয়ে দিতে পারছে। এই জেলাতেই আছেন কান্তি গাঙ্গুলি ও সুজন চক্রবর্তীর মত ডাকসাইটে সিপিআই(এম) নেতা। সব মিলিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় বিজেপি এখনও অব্দি তৃতীয় পক্ষ। হাওড়া, হুগলি জেলায় তারা তৃণমূল বিরোধী প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে লোকসভা নির্বাচনের সময় উঠে এসেছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে নিজেদের অবস্থান দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। সেক্ষেত্রে এই দুটি জেলাতেও তৃণমূল বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যা আখেরে বিজেপির ক্ষতি করবে।


[  ] দক্ষিণবঙ্গের একাংশে বিজেপির মুখ নেই-

তৃতীয় ও চতুর্থ দফার নির্বাচন মিলিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভোট পর্ব শেষ হয়ে যাবে। এই জেলায় মোট ৩১ টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে। নবান্ন দখল করতে হলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ভালো ফল করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই জেলায় গেরুয়া শিবিরের কোন‌ও মুখ নেই। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চ্যাটার্জিকে তারা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছিল। একসময় মনে করা হচ্ছিল এই জেলার মুখ হিসেবে উঠে আসবেন তিনি। কিন্তু প্রার্থীপদ নিয়ে দলের সঙ্গে বিরোধের কারণে শোভন বিজেপি ত্যাগ করেন। সব মিলিয়ে বলা যায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় অভিভাবক শূন্য বিজেপি। হুগলি জেলায় অবশ্য লকেট চ্যাটার্জির মত একজন ডাকসাইটে বিজেপি নেত্রী আছেন। কিন্তু দলীয় মুখের সমস্যা তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে হাওড়াতেও। অথচ এই দুই জেলাতে একাধিক হেভিওয়েট তৃণমূল নেতার বসবাস। সব মিলিয়ে তৃতীয় দফার ভোটে আবারও যেন অনেকটা ব্যাকফুটে বিজেপি।


[  ] সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকা-

প্রথম দুটি দফায় যে ৬০ টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে সেখানে সংখ্যালঘু ভোট ফ্যাক্টর হবে এরকম কেন্দ্রের সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিল। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের যে কেন্দ্রগুলোতে ভোট হবে সেখানে সংখ্যালঘু ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটার। হাওড়া এবং হুগলিতেও সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আবার চতুর্থ দফায় ভোট হবে কোচবিহারে। সেখানেও সিতাই, তুফানগঞ্জের মত সংখ্যালঘু প্রভাবিত কেন্দ্র আছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করার জন্য বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ওপর ভরসা রাখছে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় সংখ্যালঘু শিবিরের ভোট তারা পাবে না। তৃণমূল বিরোধী যে সমস্ত সংখ্যালঘু ভোটার ছিলেন তাদেরও বেশিরভাগের ভোট আব্বাস সিদ্দিকীর মাধ্যমে সংযুক্ত মোর্চার ঝুলিতে গিয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই হিসেব মাথায় রাখলে তৃতীয় ও চতুর্থ দফার ভোটে অর্ধেক শক্তি নিয়ে খেলতে নামতে হচ্ছে বিজেপি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভালো ফলের সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।


সব মিলিয়ে বলা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের ঘাঁটিতে প্রবেশ করে কিছুটা যেন দিশেহারা হয়ে পড়ছে বিজেপি। তবে নবান্ন দখল করতে হলে যাবতীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে মমতাকে হতাশ করে তুলতে পারাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত গেরুয়া শিবিরের। না হলে লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়ত সম্ভব হবে না।