বুমরা নামটা আজকাল ভারতীয় ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে প্রায় বিরাট কোহলির সমপর্যায়ের জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কুয়াশায় মাখা শীতের সকালে চায়ের আড্ডা জমিয়ে দিতে অস্ট্রেলিয়া সফরে জশপ্রীৎ বুমরা বনাম স্টিভ স্মিথ বা ডেভিড ওয়ার্নারের দ্বৈরথের প্রসঙ্গই যথেষ্ট। ভারত ক্রিকেট পাগল দেশ, আর টেস্ট হোক বা টি- টোয়েন্টি, ভারতীয় ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের মধ্যে এই মুহূর্তে সেরার তকমা জশপ্রীৎ বুমরার দখলে।
ভারতীয় ক্রিকেট বরাবরই বিশ্বকে উপহার দিয়েছে অমর প্রতিভা। ব্যাটসম্যান হোক কিংবা বোলার, এমনকি বিশ্বের সেরা ফিল্ডারদের তালিকাতেও প্রথম দিকেই খুঁজে পাওয়া যাবে কোনো না কোনো ভারতীয় নাম। আমেদাবাদের জশপ্রীৎ বুমরা বিশ্বের সেই প্রথম সারির বোলারদের মধ্যে অন্যতম।
গুজরাটের ২৭ বছর বয়সী জশপ্রীৎ বুমরা কীভাবে বিশ্বের দরবারে নিজের নামকে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তার কাহিনী জানার আগে আসুন জেনে নিই এই মুহূর্তে পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব ক্রিকেটে বুমরার অবস্থান।
বুমরার বর্তমান পরিসংখ্যান:
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জশপ্রীৎ বুমরার বোলিং পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য রকমের উজ্জ্বল।এখনও পর্যন্ত ভারতের জার্সি গায়ে মোট ১৪টি টেস্ট খেলেছেন তিনি। টেস্টে মোট ৩০৮১টি বল করে ৬৮টি উইকেট নিয়েছেন জশপ্রীৎ বুমরা। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে তাঁর বোলিং গড় ২০.৩৩। ২৭ রান দিয়ে ৬ উইকেট এখনও পর্যন্ত তাঁর সেরা টেস্ট বোলিং।
ভারতের হয়ে মোট ৬৭টি একদিনের ক্রিকেট খেলেছেন জশপ্রীৎ বুমরা। ৩৫২৩ টি বল করে তিনি নিয়ে ফেলেছেন ১০৮টি উইকেট। বোলিং গড় (২৫.৩৩) চোখে পড়ার মতো ভালো। এক্ষেত্রেও ২৭ রান দিয়ে ৫ উইকেট বুমরার সেরা রেকর্ড।
কুড়ি ওভারের খেলাতে ভারতের জার্সি গায়ে জশপ্রীৎ বুমরাকে দেখা গেছে ৫০টি ম্যাচে। ১০৭৫ বার বল ছুঁড়ে তিনি পকেটে পুড়ে ফেলেছেন ৫৯টি উইকেট। সেরা বোলিং মাত্র ১১ রান দিয়ে ৩ উইকেট।বস্তুত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বর্তমানে শুরুর ওভার গুলোয় নতুন বল আর শেষের ওভার গুলোয় ডেথ বোলিংয়ে অধিনায়ক বিরাট কোহলির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বোলার যে জশপ্রীৎ বুমরা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
বুমরার বর্তমান ICC ranking:
এই মুহূর্তে আইসিসির তালিকা অনুযায়ী একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭০০ পয়েন্ট নিয়ে জশপ্রীৎ বুমরা রয়েছেন ৩ নম্বরে। ভারতের মধ্যে তাঁর স্থান প্রথম। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি আছেন ৯ নম্বরে। আর কুড়ি ওভারের খেলায় বুমরার স্থান ১১।
বুমরার পারিবারিক জীবন:
জশপ্রীৎ বুমরার মা দিলজিৎ বুমরা একজন সিঙ্গেল মাদার (single mother)। তিনি আমেদাবাদে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে বুমরাকে বড় করে তুলেছেন। গুজরাটের এক নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জশপ্রীৎ বুমরা।
ঘরোয়া ক্রিকেটে জশপ্রীৎ বুমরা:
ডানহাতি ফাস্ট বোলার জশপ্রীৎ বুমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেন গুজরাটের হয়ে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিদর্ভের বিরুদ্ধে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেকের ম্যাচেই ৭ উইকেট নিয়ে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন জশপ্রীৎ বুমরা। টুর্নামেন্টের সেরা বোলারও হয়েছিলেন তিনি।
সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে ২০১২-১৩ সসালেই প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলেন বুমরা। প্রতিপক্ষ ছিল মহারাষ্ট্র। মাত্র ১৪ রান দিয়ে এবং ৩ উইকেট নিয়ে অনায়াসে জিতে নিয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচের শিরোপা। বুমরার দাপটেই সেবার ট্রফি জিতেছিল গুজরাট। ঘরোয়া ক্রিকেটে জশপ্রীৎ বুমরার এই নজরকাড়া প্রদর্শন যে নির্বাচকমণ্ডলীর দৃষ্টি এড়ায় নি, তা বলাই বাহুল্য।
আইপিএলে জশপ্রীৎ বুমরা:
ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলা দেখিয়ে অনায়াসেই আইপিএলে জায়গা করে নেন জশপ্রীৎ বুমরা। ২০১৩ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন তিনি। সেবার আইপিএলে বিরাট কোহলির আরসিবি বা রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে বুমরার বোলিং হয়তো তাঁর জীবনের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট।
অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশনের অচেনা ‘বাচ্চা’ ছেলেটাকে প্রথমেই পর পর তিনটে চার মেরেছিলেন আরসিবি অধিনায়ক। ব্যাঙ্গালোরের ভক্তদের মুখে তখন নতুন বোলারের জন্য ছিল অবজ্ঞার হাসি। কিন্তু পরের বলটাতেই সেই হাসি মিইয়ে যায়। একই ভঙ্গিতে ফের মাঠের বাইরে বল পাঠাতে গিয়ে ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন বিরাট। ভারতীয় ক্রিকেটে জশপ্রীৎ বুমরার উত্থান ঠিক সেই উইকেটটা থেকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বুমরা:
আইপিএলে অস্বাভাবিক রকম ভালো প্রদর্শনের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বুমরার ডাক পড়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবু ভারতের জার্সি গায়ে দিতে তাঁর সময় লেগেছিল আরো ৩ বছর। ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি ভারতের হয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম মাঠে নামেন বুমরা। তারপর থেকে খুব ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতীয় দলে বুমরার জায়গা ছিল পাকা।
২০১৮ সালে সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলার ডাক আসে বুমরার জন্য। পাঁচদিনের খেলাতেও বল হাতে সমান পারদর্শিতার পরিচয় দেন তিনি। তারপর থেকে বুমরার কেরিয়ার গ্রাফ ক্রমশ উর্দ্ধমুখী। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাঁকে। একাধিক বার আইসিসির ওয়ানডে বোলারের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করেছেন তিনি। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল শারিরীক সুস্থতা। অন্যান্য ফাস্ট বোলারদের মতো চোট পাওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম বুমরার। নিজেকে সুস্থ ফিট রাখতে পারাই বুমরার সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। এক কথায়, বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে জশপ্রীৎ বুমরা ছাড়া ভাবাই যায় না। আরো অন্তত ৮ থেকে ১০ বছর বল হাতে মুগ্ধ করবেন বুমরা, এমনটাই আশা আপামর ক্রিকেটপ্রেমীর।
https://www.banglakhabor.in/wp-admin/post.php?post=8965&action=edit