আজ থেকে ৪০ বছর আগে, ১৯৮০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর, জন লেননের মৃত্যুর খবর আলোড়ন তুলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। পরবর্তী এক সপ্তাহ হাজার হাজার ক্রন্দনরত ভক্ত ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন লেননের বাসগৃহের চত্বরে। তাঁর অপ্রস্তুত মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শীরা আজও সেই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল ‘বিটল্সে’র প্রাণ তথা বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় পপসঙ্গীতশিল্পী লেননের ?
সেই ৮ই ডিসেম্বর নিউইয়র্কে একটা স্টুডিও রেকর্ডিং সেরে, স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে ম্যানহ্যাটনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ফিরছিলেন জন লেনন । রাত তখন ১০টা ৫০, বাড়ি ঢোকার মুখেই আচমকা পেছন দিক থেকে পরপর চারটি গুলি এসে বেঁধে লেননের শরীরে। একটি পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবার রাইফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। অপরাধী একজন বিটলস ভক্ত আমেরিকান, নাম মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান, বয়েস ২৫। গুলি করেও সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে শেষ দেখার জন্য, যতক্ষণ না পুলিশ এসে তার হাতে হাতকরা পড়ায় । অন্যদিকে প্রবল রক্তপাত হতে শুরু করেছিল গুলিবিদ্ধ লেননের শরীর থেকে। একটি পুলিশের গাড়িতে করে সঙ্গে সঙ্গেই রুজভেল্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় লেননকে কিন্তু চিকিৎসার সুযোগ হয়নি। রাত ১১টা ১৫ নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্রই চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
লেননের মৃত্যু সকলকে অপরিসীম শোকে আচ্ছন্ন করে। বিপুল জনতা রুজভেল্ট হাসপাতালে এবং ডাকোটার সামনে জড়ো হয়েছিল। লেননের বাড়ির আশেপাশের আবাসনের মানুষ নিজেদের জানালায় জানলায় মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। বিটলসের তিনজন ভক্ত আত্মহত্যা করেছিলেন যন্ত্রণায় । ১২ই ডিসেম্বর নিউইয়র্কের ফার্নক্লিফ কবরস্থলে লেননকে সমাধিস্থ করা হয়।
প্রথাগত ফিউনারেল না করে বিশ্বজুড়ে ১0 মিনিটের নীরবতা পালনের মাধ্যমে লেননের আত্মার শান্তি কামনায় অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্ত্রী ওনো। ১৪ ই ডিসেম্বর, বিশ্বব্যাপী কয়েক লক্ষ মানুষ সেটিকে সমর্থন করেন। লেননের কথা স্মরণ করতে ৩0,000 মানুষ লেননের নিজ শহর লিভারপুলে জড়ো হয়েছিলেন এবং ২২৫,000 এরও বেশি মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন সেন্ট্রাল পার্কে। এই দশ মিনিটের জন্য, নিউইয়র্ক শহরের প্রতিটি রেডিও স্টেশনও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
চ্যাপম্যান বেশ কয়েক মাস ধরে এই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা যায়। হাওয়াই থেকে এসে ৮ ডিসেম্বর সে ডাকোটাতে লেননের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেইদিন সে লেননের সঙ্গে দেখা করে ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবামের একটা কপিতে তাঁর সাক্ষরও নিয়েছিল।
বিচারের সময় চ্যাপম্যান জানিয়েছিল যে, সে লেননের জীবনযাত্রা পছন্দ করত না এবং সম্প্রতি জনসাধারণের প্রতি তাঁর কিছু বক্তব্যে সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল । বিশেষত লেননের সেই উক্তি, যেখানে তিনি মন্তব্য করেছিলেন- ‘বিটলস এখন যিশুর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়’ সে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। এছাড়াও তাঁর ‘গড’ এবং ‘ইম্যাজিন’ গানের কথাগুলোও চ্যাপকে অসন্তুষ্ট করেছিলো। চ্যাপম্যান এও জানিয়েছিল যে সে জে ডি ডি সালঞ্জার উপন্যাস ‘দ্য ক্যাচার ইন রাই’-র কাল্পনিক চরিত্র হোল্ডেন কুলফিল্ড থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
লেননকে হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল চ্যাপম্যান। তার মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ স্পষ্ট হলেও নিউইয়র্কের একটি কারাগারে তাকে ২0 বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২000 সালে জামিন যোগ্য হওয়ার পরে এখনো অবধি তাকে এগারো বার প্যারোলে অস্বীকার করা হয়েছে । পরবর্তী সময়ে নিজের মুর্খামি স্বীকার করে চ্যাপ যদিও ক্ষমা চেয়েছে। লেননকে খুন করে সে নাকি নিজে গর্বিত হতে চেয়েছিল!
ওয়েনডে সংশোধনাগারের প্যারোল বোর্ডকে দেওয়া চ্যাপের কিছু বয়ান ছিল এরকম-
“I just want to reiterate that I’m sorry for my crime,”
“I assassinated him, to use your word earlier, because he was very, very, very famous and that’s the only reason and I was very, very, very, very much seeking self-glory, very selfish,”
“He was extremely famous. I didn’t kill him because of his character or the kind of man he was. He was a family man. He was an icon. He was someone that spoke of things that now we can speak of and it’s great’’
‘রক অ্যান্ড রোল’ অনুপ্রাণিত প্রখ্যাত গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী এবং রিদম গিটারিস্ট লেনন শুধু একজন পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ পপতারকাই নন, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনেক বড়। সবসময় হালকা চালে থাকতেন। শান্তিকর্মী ছিলেন তিনি, সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। লেনন মানুষকে ভালবাসতেন , বিশ্বাস করতেন; আর সেই ভালবাসাই হয়ত তাঁর জীবনে ফেরত এল মৃত্যু হয়ে।
গান রচনার ক্ষেত্রে পল ম্যাককার্টনির সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দীর রসায়ন পপসংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল একটি ঘটনা। জন ১৯৬৯ সালে জাপানি গীতিকার ও শিল্পী ইয়োকো ওনোকে বিয়ে করে তাঁর সঙ্গে শুরু করেন ‘ প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ড’। ১৯৭০ সালে বিটলস গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে লেনন একক শিল্পী এবং ওনোর সহযোগী হিসেবেই কাজ করে যান।
স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে ছিল অচ্ছেদ্য ভালোবাসা। ১৯৬৯ সালের পর থেকে লেননের জীবনের পুরোটাই জুড়ে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়োকো ওনো। লেননের মৃত্যুর পর ডাকোটার সেন্ট্রাল পার্কের রাস্তার পাশ বরাবর ২.৫ একর জমিতে ওনো গড়ে তুলেছিলেন ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস’, ভালবাসার মানুষটির স্মৃতিতে। বিটলসের বিখ্যাত গান ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস’- এর নামেই এই অপূর্ব ভূখণ্ডটির নামকরণ। সেখানে দাঁড়ালে আজও মানুষের বুকের মধ্যে বাজতে থাকে লেননের কন্ঠ –
‘‘Nothing is real
And nothing to get hung about
Stwaberry Fields forever …’’