বাঙালি ও শীতকাল, এই দুটি শব্দ মিলেমিশে একটাই অর্থে পরিণত হয় তা হল ঘোরাঘুরি। একঘেয়ে জীবন যাপন থেকে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, বাড়ির বাইরে বেরোতে চাইছেন কিন্তু করোনার আতঙ্ক পিছন ছাড়ছে না। তবে চলুন না কাছাকাছি কোথাও কিছুক্ষণের অবসর সময় কাটিয়ে নেওয়া যাক। তাহলে চলুন দেখে নিন এমন কয়েকটি জায়গা যেগুলি কলকাতার অত্যন্ত কাছাকাছি। যেখানে আপনি খুব সহজেই পৌঁছতে পারবেন এবং মন ভরে অবসর সময়টিকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর হ্যাঁ সেখানে গিয়েই দিনের দিন ফিরে আসতে পারবেন অর্থাৎ আপনার থাকার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। কি ভাবছেন আর দেরি না করে ঘুরেই আসুন।

১. বরতির বিল (নীলগঞ্জ,বারাসাত)

ঘোরাঘুরি
ছবি সৌজন্যে ইউটিউব

বারাসাত নীলগঞ্জ বাজারের কাছেই এই বরতির বিল। যারা প্রাকৃতিক শোভা পেতে চান তারা একবার ঘুরে আসতেই পারেন। আসলে জায়গাটি হল কয়েকটি বিল অর্থাৎ জলা জায়গা বা ডোবা নিয়ে। তবে একদমই ভাববেন না যে এই জায়গায় আবার দেখার মতন কি আছে। যদি না জান তবে বুঝতে পারবেন না। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, সূর্য অস্ত যাওয়ার এমনকি ভাগ্যক্রমে নৌকো চড়াও যদি কপালে জুটে যায় তাহলে তো কোন কথাই নেই। শহরের মাঝে এরকম নির্মল প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই কম বললেই ভাল। আর হ্যাঁ এই জায়গাটির কোন কিছুই কিন্তু আর্টিফিশিয়াল অর্থাৎ মানুষ নির্মিত নয়, আসলে এই ডোবা গুলি চাষের জল ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় বহু কাল ধরে এই ডোবা গুলি এই ভাবে ব্যবহৃত হতে হতে এক প্রাকৃতিক সুন্দর পর্যায়ে পৌছে গেছে। জায়গাটির সৌন্দর্য তা মুখে বলে প্রকাশ করা খুবই অসম্ভব। কি ভাবছেন কাছেই তো একদিন টুক করে চলে যান, আর দেখে আসুন বরতির বিল।

২. কলকাতা স্নেক পার্ক

8THGUINDY
ছবি সৌজন্যে দ্য হিন্দু ডট কম

যদি পশু পাখি জীবজন্তুর প্রতি আগ্রহ থাকে তবে কলকাতা স্নেক পার্ক ঘুরে আসতে পারেন। ১৯৭৭ সালে এই পার্কটি নির্মিত হয়, এবং তখন থেকেই এটি শুরু। একদিনের ঘোরার জন্য যথেষ্ট সুন্দর একটি জায়গা। চারিদিকে গাছগাছালিতে ভরা এবং তার সাথে সাথেই দেখা পেতে পারেন কিছু কিং কোবরা বা পাইথন। চিড়িয়াখানা তো অনেক বারই গেছেন, তাহলে একবার স্নেক পার্কেও ঘুরে আসুন।

৩. চিন্তামণি পার্ক ও পাখিরালয়

5de797809e9c584ef6b6ec2e 1575458688055
ছবি সৌজন্যে এল বিবি

আপনি যদি নিত্যান্তই প্রকৃতি প্রেমিক হন তবে চিন্তামনি পার্ক পাখিরালয় আপনার জন্য একটি যোগ্য ঘোরাঘুরি জায়গা। কলকাতা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে এই পার্কে আপনি বিভিন্ন রকম পাখির সমাহার দেখতে পাবেন। যেমন- কাঠঠোকরা, মাছরাঙ্গা এছাড়াও বুলবুল পাখির বিভিন্ন প্রজাতি আরো অনেক রকমের পাখির দেখা পাবেন। পাখির সাথে সাথেই এখানে অনেক ধরনের গাছ ও ফুলের সমাহার দেখতে পাবেন। চিন্তামণি পার্ক ও পাখিরালয় যাওয়ার সবথেকে সঠিক সময় শীতকাল। কেননা শীতকালে বহু নাম না জানা পাখি এখানে আসে এবং শীতকাল শেষ হওয়ার পর তারা নিজেদের জায়গায় ফিরে যায়। এই পার্কের এন্ট্রি ফি 50 টাকা করে জনপ্রতি ও পার্কটি খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি। তবে আর দেরি না করে একবার ঘুরে আসুন চিন্তামণি পার্ক ও পাখিরালয়।

৪. শিবপুর

Webp.net compress image 1 13
ছবি সৌজন্যে ট্রিবো ডট কম

হুগলি নদীর পাড়ে অবস্থিত কলকাতার মধ্যে নির্মল প্রাকৃতিক দৃশ্য যদি পেতে চান তবে নিশ্চয়ই শিবপুর ঘুরে আসতে পারেন। নির্মল প্রাকৃতিক আনন্দ আপনার একঘেয়ে জীবন কে এক নতুন স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলবে। এছাড়াও ঘুরে আসতে পারেন শিবপুর এর কাছে জগদীশচন্দ্র বসুর বোটানিক গার্ডেনে। এই বোটানিক গার্ডেনে আপনি দেখতে পারেন বহু বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন রকমের গাছ যাদের বিভিন্ন রকম গুনাগুন এমনকি দেখতেও তাদের বিভিন্ন রকম। তাহলে কী ভাবছেন এই শহরের কোলাহল ছেড়ে একটু প্রকৃতির মধ্যে নিজের সময়টা কাটিয়ে দেখুন।

৫. আছিপুর (বজবজ)

achipur chinese temple 9
ছবি সৌজন্যে দ্য ইণ্ডিয়ান ভ্যগাবন্ড

বজবজ এর কাছে একটি অত্যন্ত সুন্দর ঘোরাঘুরি জায়গা হল আছিপুর। আছিপুর দেশের এমন একটি জায়গা যার সাথে পুরনো চিনা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে। এই জায়গাটি সমগ্র দেশের একটি মাত্র জায়গা যেখানে আপনি চিনা সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাবেন। শুধুমাত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্যই নয় এখানে আপনি বহু রকমের চিনা খাবারের স্বাদও গ্রহণ করতে পারেন। আছিপুরের জায়গায় জায়গায় চাইনিজ খাবারের সম্ভার আপনার চোখে পড়তে বাধ্য। এছাড়াও এখানে কাছাকাছি বহু মন্দির আপনি দেখতে পারেন। আছিপুর আসার সঠিক সময় যদি বলেন তবে বলতেই হয় অন্তত একটিবার চাইনিজ নিউ ইয়ারে এখানে ঘুরে আসুন। চাইনিজ নিউ ইয়ারে এই জায়গাটির এক আলাদাই রূপ আপনার চোখে পড়বে। এককথায় বলতেই পারেন পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আছিপুর একখণ্ড চীনই বটে। আর হ্যাঁ এখানে আসলে বজবজ ফেরিঘাট ঘুরতে ভুলবেন না যেন।

৬. চন্দ্রকেতুগড়

1527530220 1
ছবি সৌজন্যে ট্রিপ্তো

কদম্বগাছি, বেড়াচাঁপার কাছাকাছি বিদ্যাধরী নদীর তীরে চন্দ্রকেতুগড় । আপনি যদি ঐতিহাসিক স্থান পছন্দ করেন তবে চন্দ্রকেতুগড় আপনার জন্য খুবই পছন্দের একটি জায়গা হতে পারে। চন্দ্রকেতুগড় জায়গাটি ২৫০০ সাল আগে চন্দ্রকেতু বংশের প্রথম রাজা এই জায়গাটির নির্মাণ করেন এবং এখানে তার মহল অর্থাৎ চন্দ্রকেতু দুর্গ নির্মাণ করেন সাথে সাথেই বহু ছোটখাটো স্থাপত্যেরো নির্মাণ করেন। যদিও আজ সেই স্থাপত্য গুলির ভগ্নাবশেষ দেখতে পাবেন কিন্তু চন্দ্রকেতু দুর্গ ভারত সরকারের অধীনে থাকার জন্য এখনো অব্দি কিছু ভগ্নাবশেষ টিকে রয়েছে। এছাড়াও চন্দ্রকেতুগড়ে আপনি দেখতে পাবেন খানা মিহিরের বহু পুরনো একটি জাহাজ যা বহু যুগ ধরে একই জায়গায় বাধা রয়েছে। এই জাহাজের নকশা অত্যন্ত অন্যরকম একটি পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও কাছে একটি মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে আপনি ২৫০০ বছর পুরনো টেরাকোটা, মাটির কাজ আরো অনেক কিছু দেখতে পাবেন। যদি একটি দিনের জন্য আপনি নিজেকে ইতিহাসের সাথে জুড়ে রাখতে চান তবে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন চন্দ্রকেতুগড়।

৭. চিনসুরা বা চুঁচুড়া

Susana Anna Maria Tomb
ছবি সৌজন্যে উইকিপিডিয়া

চুঁচুড়ার বহু আগের নাম ছিল চিনসুরা। ওলন্দাজরা যখন ভারতে আসেন তারা প্রথম চুঁচুড়া বা চিনসুরাতে পদার্পণ করেছিল। সেই থেকে চুঁচুড়ার নাম হয়েছিল চিনসুরা। চুঁচুড়ায় যদি আপনি যান তবে দেখতে পাবেন ওলন্দাজদের তৈরি ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি। চুঁচুড়া হুগলি নদীর তীরে একটি শহর যেখানে আজও ওলন্দাজদের সংস্কৃতির ছোঁয়া পেতে পারেন। এছাড়াও এখানে আপনি ওলন্দাজদের তৈরি বাগান, ওলন্দাজদের কবরস্থান যেটি একটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে মনে করা হয়। চুঁচুড়ার অত্যন্ত একটি বিখ্যাত স্থাপত্য হলো ” সাত সাহেবের বিবির কবর” অথবা “মেম সাহেবের কবর”। এই স্থাপত্যটি ১৮০৯ সালে তৈরি হয়, ৮ কোনা এই স্থাপত্যে ভারতীয়-ওলন্দাজ ছোঁয়া দেখতে পাবেন। এটি একটি ওলন্দাজ নারীর কবর। লোকমুখে শোনা যায় তার নাকি ৭ স্বামী ছিল। এই গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্ব বিখ্যাত কবি রাস্কিন বন্ড একটি গল্প লেখেন এবং যেটি পরবর্তীকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় গল্প হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাহলে চলুন একদিন ঘুরেই আসুন চুঁচুড়া থেকে।

৮. পিয়ালী দ্বীপ

55175d1394365002 piyali island 2
ছবি সৌজন্যে ইণ্ডিয়া মাইক

শহর থেকে কিছুটা দূরে যদি নির্জন জায়গায় নদী ও সমুদ্রের ধারে নিজের কিছুটা অবসর যাপন করতে চান তবে অবশ্যই পিয়ালী দ্বীপ একটি অন্যতম জায়গা বলা যেতেই পারে। ছোটখাটো ফ্যামিলি পিকনিক বলুন, বা একান্তে আপনে বেড়ানোই বলুন সবকিছুতেই পিয়ালী দ্বীপ কিন্তু একটা যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ মূলক জায়গা। ওখানে গেলেই আপনি চারিদিকে শুধু মাত্র ছোটখাটো নদী যেগুলি সমুদ্রের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সে গুলি দেখতে পাবেন। অসম্ভব সুন্দর এক মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার মন কাড়তে বাধ্য। কলকাতা শহর থেকে বেশি দূরেও নয়, চাইলে আপনি সহজেই গাড়ি নিয়ে দুই থেকে তিন ঘন্টার একটি ছোট্ট জার্নি করে পৌঁছে যেতে পারেন পিয়ালী দ্বীপে। পিয়ালী দ্বীপে অনেক রেসর্ট, হোটেল ছোট ছোট থাকা খাওয়ার জায়গা সব সময় পাওয়া যায়। তবে চলুন ফ্যামিলি পিকনিক হয়েই যাক।

৯. টাকি

msid 69635314,width 96,height 65
ছবি সৌজন্যে টাইমস ওফস ইন্ডিয়া

টাকি হলো বাঙালির অত্যন্ত কাছের একটি জায়গা। টাকি যেতে হলে আপনি দু’রকম ভাবেই যেতে পারেন। চাইলে আপনি ট্রেনেও যেতে পারেন আবার বাসেও যেতে পারেন। এই ছোট্ট শহরটি ইছামতি নদীর ধারে অবস্থিত। পুরনো সময়ের স্থাপত্য, সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা টাকির এক বৈশিষ্ট্য বলা চলে। চাইলেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন টাকি থেকে।

১০. ইকোপার্ক

28 20180529110508
ছবি সৌজন্যে হলইডে ফ্লাই

কলকাতার নিউ টাউনে অনেক বড় একটি জায়গা জুড়ে ইকোপার্ক তৈরি হয়েছে। এই পার্কটি যতটাই না সুন্দর ঠিক ততটাই আকর্ষণীয়। কলকাতা শহরের একদম কাছের একটি জায়গা আপনি যখন চান সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। পার্কটির মধ্যে একটি বিশাল আকারের কৃত্রিম ঝিল তৈরি করা হয়েছে। ঝিল কে কেন্দ্র করে সমগ্র পার্কটি তৈরি হয়েছে। পার্কের মধ্যে অনেক রকম সুব্যবস্থা রয়েছে যেমন- বাচ্চাদের জন্য দোলনা স্লিপ প্রভৃতি, বোটিং সাইকেলিং এছাড়াও টয়ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কটি প্রধানত তিন চারটি অংশে বিভক্ত যার মধ্যে প্রথম অংশটি ঝিল কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে, দ্বিতীয় অংশটি তৈরি হয়েছে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য নিয়ে এবং 3 ও 4 নম্বর অংশটি প্রধানত বিভিন্ন রকম ফ্লোটিং রেস্টুরেন্ট ও ম্যারেজ হল নিয়ে তৈরি হয়েছে। পার্কটির প্রধান আকর্ষণ যদি ধরা হয় তবে তা হল সেই কৃত্তিম ঝিল এই ঝিলের ধারে আপনি অনায়াসে নিজের অবসর সময় কাটিয়ে ফেলতে পারেন। পার্কটির এন্ট্রি ফি মোটামুটি 30 টাকা থেকে শুরু ও পার্কটি খোলা থাকে সকাল 12 টা থেকে রাত আটটা অব্দি। তবে আর দেরি না করে ঘোরাঘুরি করে আসুন ইকোপার্ক থেকে। আমার বিশ্বাস এত সুন্দর একটি সুসজ্জিত জায়গা আপনাদের মন কাড়তে সক্ষম।

কাছাকাছি একদিনের জন্য দশটি ঘোরার জায়গার নাম এবং কিভাবে যাবেন ও সাথে কি কি দেখবেন তা বলার চেষ্টা করলাম। আশা করি এই শীতকালে আপনাদের একদিনের ঘোরাঘুরি এর জন্য এই সমস্ত জায়গা যথেষ্ট ভালো লাগবে। যদি আপনাদের মনে আরো অন্যান্য জায়গার নাম থাকে তবে অবশ্যই আমাকে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না এবং সাথে সাথেই আপনাদের এই জায়গাগুলির মধ্যে কোন কোন জায়গা অধিক প্রিয় সেটাও জানাতে পারেন কমেন্ট বক্সে।