দুর্গা পূজোর রেষ কাটতে না কাটতেই জগদ্ধাত্রী পূজোর সময় উপস্থিত । চন্দননগর, কৃষ্ণনগর সহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পূজোর আয়োজনে ব্যস্ত বহু মানুষ। এই পূজো কীভাবে বঙ্গদেশে প্রচলিত হল এবং এই দেবীর পৌরাণিক মাহাত্যই বা কি সেই ইতিহাস অনেকরই অজানা । সেই অজানা ইতিহাসের নাগাল পেতে অবশ্যই পড়ুন আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনটি । এছারাও কোভিড19 র জন্য এত বছর ধরে চলে আসা পূজোর কিছু ঋতিনীতিতেও পরির্তন আনছে আয়োজকেরা, সেগুলি কি, জেনেনিন এই প্রচ্ছদে ।
পরিচ্ছদসমূহ: |
1. 2020 সালের পূজোর নির্ঘন্ট ও সময়সূচী |
2. পুরাণ আখ্যান |
3. ঐতিহাসিক আখ্যান |
4. কিছু মতান্তর |
5. স্বাস্থ্যবিধির ঘেরাটোপে পূজোর আয়োজন |
1. 2020 সালের পূজোর সময়সূচী:
ইতিমধ্যে চন্দননগর, গুপ্তিপাড়া, কৃষ্ণনগর, জয়রামবাটি, বেলুরমঠ সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন শুরু হয়ে গেছে জগদ্ধাত্রী পূজোর । তবে শুরুতেই এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই চলতি বছরে পূজোর সময়সূচী । নবমীতিথিতেই জগদ্ধাত্রী পূজোর মূল পূজোটি আয়োজিত হয়, 2020 সালে 22 শে নভেম্বর, রাত 10 টা 51 মিনিটে নবমীতিথি প্রারম্ভ এবং শেষ হবে 24 শে নভেম্বর, রাত 12 টা 32 মিনিটে । মূলত দুটি ভিন্ন প্রথার প্রচলোন আছে এই পূজোতে, অনেকে দুর্গা পূজোর মত সপ্তমী, অষ্ঠমী, নবমী, তিনদিন ধরে আলাদাভাবে পূজো করে আবার অনেকে নবমীতিথিতেই একসাথে সপ্তমী, অষ্ঠমী, নবমী র পূজো তিনবারে সম্পন্ন করে । এই পূজোর বাকি সব বিধি অনেকাংশেই দুর্গা পূজোর অনুরূপ । এই পূজো তান্ত্রিক পূজো, তবে দুর্গা পূজোরন্যায় এখানেও কুমারী পূজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে ।
যে-কোনো সাধনায় মনকে সংযত করে বশে আনা সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের মন মত্ত করী, মন-করীকে বশ করতে পারলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী।… মত্ত মন-করীকে বশ করে সাধক-হৃদয়ে জগদ্ধাত্রীর প্রতিষ্ঠায়ই জগদ্ধাত্রী-সাধনার সার্থকতা, পূজার পরিসমাপ্তি।
– স্বামী নির্মলানন্দ
2.পুরাণ আখ্যান:
হিন্দু ধর্মানুযায়ী মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা এবং তামসিক কালীর পরের স্থানটিই হল এই সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর, উপনিষদে যাকে চিহ্নিত করা হয় ‘উমা হৈমবতী’ নামে । দেবী ভাগবত পুরাণ ও অন্যান্য পুরান মতে, অসুর বধের পর দেবতারা খুব অহংকারি হয়ে ওঠেন এবং তারা মনে করেন ব্রহ্মের বলে বলীয়ান (মতান্তরে মহাশক্তি পার্বতীর শক্তিতেই তারা বলীয়ান) হয়েই বিজয়প্রাপ্তি ঘটেছে । তখন দেবতাদের এই অহংকার ভাঙতে দেবী পার্বতী এক সামান্য তৃণখণ্ড ছুরেদেন তাদেরদিকে । দেবরাজ ইন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, বরুনদেব ব্যার্থ হন এই তৃণখণ্ডকে নষ্ট করতে । তখনই ব্রহ্মরূপী দেবী পার্বতী চর্তুর্ভুজা, ত্রিনয়না, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ‘উমা হৈমবতী’ রূপে দর্শনদেন দেবরাজ ইন্দ্র কে । দেবীর মাহাত্যে দেবগন তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে সক্ষম হন ।কাত্যায়ণী তন্ত্রের 76 অধ্যায়েও এই কাহিনীর উল্লেখ মেলে ।
আরেকটি বহু প্রচোলিত পৌরাণিক উপাখ্যান হল, জগদ্ধাত্রী দেবী করীন্দ্রাসুর (মহাহস্তীরূপী অসুর) কে বধ করেছিলেন, তাই অনেক জায়গায় এই দেবীকে ‘জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী’ নামেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে । অনেক গ্রন্থে এও উল্লেখ আছে যে মহিষাসুরের সাথে দেবী দুর্গার যুদ্ধের সময় মহিষাসুর হাতির রূপ ধারন করে এবং দেবী দুর্গা তখন চর্তুর্ভুজা হয়ে সেই অসুরের নিধন করেন । দেবীর বাহ্যিক রূপের বর্ননা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দেবী চর্তুর্ভুজা, ত্রিনয়না, সিংহবাহিনী, হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ, গলায় নাগযজ্ঞোপবীত এবং গাত্রবর্ণ ‘উদিয়মান সূর্য’ র ন্যায় ।
3. ঐতিহাসিক আখ্যান:
বাংলায় দুর্গা পূজো প্রচলনের বহু পরে জগদ্ধাত্রী পূজোর সূচনা হয় । ইতিহাসনুযায়ী অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজো আরম্ভ করেন । কৃষ্ণচন্দ্র রায় পলাশির যুদ্ধে পরোক্ষভাবে ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন । নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর গদিতে বসেন মীর কাশিম । মীর কাশিম (মতান্তরে আলিবর্দি খা) বন্দি করেন কৃষ্ণচন্দ্র রায় কে তবে লর্ডক্লাইভের মধ্যস্তায় কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেন মীর কাশিম । সেবার বন্দি থাকার দরুন কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গা পূজো করতে না পারায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কৃষ্ণনগরে শুক্লা নবমীতে শুভ সূচনা করেন জগদ্ধাত্রী পূজোর । পূজোর সময় কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির দরজা আজও খোলা থাকে। 1772 এ কৃষ্ণনগরের সাধারন মানুষের বাড়ীতেও এই পূজো আরম্ভ হয় । কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ার ‘বুড়িমার’ পূজো দেখতে আজও মানুষের ভীড় লক্ষ্যণীয় । বর্তমানে কৃষ্ণনগরে দুই শতরও বেশী পূজো হয় ।
জগদ্ধাত্রী পূজোর ইতিহাস ঘাটলে কৃষ্ণনগরের পর যে স্থানটির উল্লেখ আসে সেটা হল চন্দননগর । এখানে জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রবর্তক কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ, ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ । চন্দননগরে প্রথম পূজো আয়োজিত হয় লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে । এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প করা হয়ে থাকে। এই প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। জনশ্রুতি আছে বিসর্জনের সময় প্রতিমা জলে পড়লেই সাপের দেখা পাওয়া যায়। চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার – এই চার পূজোতেই সিংহের রং সাদা দেখা যায়। এছারা চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো অশ্বত্থতলার বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত । পূজোর সময়ের চন্দননগরের আলোকসজ্জা থাকে দেখার মত ।
কৃষ্ণনগর, চন্দননগরের পরে জগদ্ধাত্রী পূজোর জন্য যে স্থানটি বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধতা লাভ করে সেটি হল জয়রামবাটি । রামকৃষ্ণপরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা হল এই জয়রামবাটি । সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে আয়োজন করা হয়ে থাকে এই পূজোর । 1877 এ মা সারদার জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রচলন করেন ।
এই পূজো প্রচলনের একটি গল্প অনেক জায়গায় উল্লেখ পাওয়া যায়, কথিত আছে, শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। 1877 তে অজানা কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুয্য চাল নিতে অস্বীকার করেন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তার স্বপ্নাদেশে ওই চালেই জগদ্ধাত্রী পূজোর আয়োজন করেন। সে বছর বিসর্জনের দিন ছিল বৃহস্পতিবার । তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি জানান। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। অবশেষে বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আজও শুক্লা নবমীতে মূল পূজোর পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে, বিশেষ পূজোর আয়োজন করা হয়, সঙ্কল্প হয় সারদা দেবীর নামে। প্রতিমার পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ।
4. কিছু মতান্তর:
ইতিহাসের পাতায় জগদ্ধাত্রী পূজো কে প্রথম প্রচলন করেছিলেন সেই নিয়ে মতভেদ দেখা যায়, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী তাঁর ‘নবদ্বীপ মহিমা’তে লিখেছেন,
মহারাজ গিরিশচন্দ্রের পূর্ব্বে অস্মদেশে জগদ্ধাত্রী পূজা প্রচলিত ছিল না। উক্ত মহারাজের যত্নে তন্ত্র হইতে ঐ মূর্তি প্রকাশিত হয়। শান্তিপুরের নিকটবত্তী ব্রহ্মশাসন গ্রাম নিবাসী চন্দ্রচূড় ন্যায়পঞ্চানন নামক জনৈক তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিত কর্তৃক ঐ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের অনুমোদিত হইলে ঐ মূর্তির পূজা আরম্ভ হয়।
– কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী
তবে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী র উক্তি অনেকই সমর্থন করেন না । কারন কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি গিরীশচন্দ্র (1802- 1841) পুজোর প্রবর্তক হলে নদিয়ার জলেশ্বর শিবমন্দির (1665) এবং দিগনগরের রাঘবেশ্বর মন্দিরের (1669) গায়ে খোদাই করা জগদ্ধাত্রী মূর্তি দৃশ্যমান থাকত না ।
আবার ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ জগদ্ধাত্রী পুজোর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না । ভারতচন্দ্র ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র, তবে তার লেখায় কেন এই পূজো প্রচলনের কথা উল্লেখ নেই তার যথার্থতা এখনও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ । আবারও লেখক অলোককুমার চক্রবর্তী তাঁর ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এবং তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বলেছেন,
“যাঁরা বলেন যে মিরজাফরের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে কৃষ্ণচন্দ্র এই পূজা করেন, তাঁদের কথাও ঠিক নয়। কেননা, মিরজাফরের কারাগারে কৃষ্ণচন্দ্র কোনওদিন বন্দি ছিলেন না। আলিবর্দির রাজত্বের ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি হয়তো এই পূজা করে থাকবেন। আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেই তিনি এই পূজা প্রচলন করেছিলেন এমন কথাও মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি আলিবর্দির কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। মুক্তিলাভ করেই যদি তিনি এই পূজা করতেন তা হলে ভারতচন্দ্র নিশ্চয়ই এর উল্লেখ করতেন।
– অলোককুমার চক্রবর্তী
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি প্রচ্ছদেও এই মতভেদের আলোচনা আমরা পেয়ে থাকি । তবে বিভিন্ন মতভেদ থাকলেও বেশীরভাগ মানুষই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কেই জগদ্ধাত্রী পূজোর সূচনাকার হিসেবে মানেন ।
5. স্বাস্থ্যবিধির ঘেরাটোপে পূজোর আয়োজন:
করোনাকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে জগদ্ধাত্রী পূজোর আচারবিধিতে পরির্তনের কথা ভাবছেন আয়োজকেরা । পূজো কমিটি থেকে জানানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং খোলা মণ্ডপে আয়োজন করা হবে পুজোর, কিন্তু ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে কম উচ্চতার প্রতিমা পুজোর পক্ষপাতী তাঁরা নন, তবে সরকারি বিধিনিষেধ থাকলে শুধুমাত্র ঘটপুজোর আয়োজন করা হতে পারে কিছু জায়গায় । এছারা কৃষ্ণনগরের পুলিশ প্রশাসন থেকে কাধে নিয়ে প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেওয়া হয়নি । সারদাপীঠেও জগদ্ধাত্রী পূজোতে সাধারন মানুষের প্রবেষ নিষিদ্ধ রাখা হবে বলে জানা গেছে । কোভিড19 র জন্য দুর্গা পূজোর মতনই এবার জগদ্ধাত্রী পূজোতেও জৌলুস থাকবে অনেকটাই কম ।
লেখাটি কেমন লাগল এবং জগদ্ধাত্রী পূজোর কিছু অজানা ইতিহাস জানা থাকলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে লিখে জানান ।