চন্দননগরের পথে পথে ইতিহাস।
চন্দননগরের পথে পথে ইতিহাস।

কথায় বলে, চন্দননগরের পথে পথে ইতিহাস। তবে সেই ইতিহাসের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে অবাক লাগে বৈকি ! ঠিক সেইরকমই এক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অধুনা চন্দননগর সরিষাপাড়াস্থিত শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর রাজবাড়ীটি। রূপকথার গল্পে পড়েছিলাম রাজবাড়ী সম্বন্ধে কিন্তু সত্যিকারের দেখলাম আজ। মন পিছিয়ে গেছিলো সুদূর অতীতে তাই হয়তো মনে হলো চন্দননগরের শ্রী যুক্ত ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ঘোড়া ছুটিয়ে নিয়ে চলেছেন,কতো মাঠ-ঘাট-নদী বনভূমি পার করে কৃষ্ণনগরের পথে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে।    

      শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর জন্ম যশোর জেলায়। পরবর্তী কালে তাঁর পরিবার চন্দননগরে চলে এসেছিলো। শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী কিছুদিনের মধ্যেই চাউলপট্টিতে চালের ব্যবসা শুরু করেন এবং  বুদ্ধির জোরে প্রচুর উন্নতি করেন। সেই সময় চন্দননগরে  ছিলো ফরাসি উপনিবেশ। যদিও খুব ছোটোবেলা থেকে ফরাসীদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। আস্তে আস্তে নিজের  অধ্যবসায়ে ফরাসী আদব-কায়দা ও ফরাসি ভাষা রপ্ত করেন।  চাউলপট্টিতে মণ মণ চাল জমা হতো তাঁর গঙ্গার ধারের আড়তে। টাকাপয়সার অভাব নেই তবুও ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের মন খারাপ। কারণ ,প্রতি বছর যখন মা দুগ্গা আসেন তখন তাদের শুধুমাত্র কাজ আর কাজ ,চাল রপ্তানি করতে হয় বিভিন্ন জায়গায়।তাই পুজোর চারটে দিন কিভাবে কেটে যায় তা তারা টেরও পান না।

চন্দননগরের মা জগদ্ধাত্রীর

সভা বসলো শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর  কাছে। নিজের প্রাসাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে করলেন বিহিত এই সমস্যার। তিনি জানালেন, দুর্গা পূজার ঠিক একমাস পরেই মাকে তিনি আনবেন হৈমন্তিকা রূপে তাঁর বাড়ি ,যেখানে থাকবে সকলের আমন্ত্রণ।  দুর্গা পুজোয় অংশ নিতে না পারার কষ্টটা ভুললেন চন্দননগরের চাউলপট্টির ব্যবসায়ীরা।ফরাসডাঙায় সেই সূত্রপাত হলো মা দুর্গার আরেক রূপের–চন্দননগরের মা জগদ্ধাত্রীর।একসময় কপর্দকশূন্য অবস্থায় যশোরে তাঁদের বিশাল জমিদারি ছেড়ে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে চন্দননগর চলে আসেন এবং নিজের চেষ্টায় চাল ও পাটের  সফল ব্যবসা করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। ফরাসি ভাষা আয়ত্তে থাকার দরুন এবং নিজ গুণে হয়ে ওঠেন ফরাসি সরকারের দেওয়ান।

গেলো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সাহায্য করতেন কৃষ্ণনগরের মহারাজকে ফরাসি সরকারের দেওয়ান। এমনকি প্রতিভাবান কবির অভাবে মহারাজ তাঁর নবরত্ন সভা সাজাতে পারছিলেন না। সেই সময়, শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী তাঁর আশ্রয়ে থাকা এক যুবার মধ্যে সেই প্রতিভার খোঁজ পেলেন। নিয়ে গেলেন তাঁকে কৃষ্ণনগরে। সেই যুবক পরবর্তী সময়ে লিখলেন ‘অন্নদামঙ্গল’ , উপাধি পেলেন ‘রায়গুণাকর’ । কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের আসন পাকা হলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে লাগলো শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রভাব, প্রতিপত্তি। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগলো তাঁর শত্রুর সংখ্যাও।

তাঁর প্রধান শত্রু ছিলেন ইংরেজরা তথা রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ বাহিনী শুধুমাত্র চন্দননগরের আক্রমণ করেছিলো শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রভূত ধন রত্ন লুঠ করতে। আক্রমণ করে তারা তাঁর বাসভবন এবং তখনকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা মূল্যের গয়না ও সম্পত্তি যা তারা সাথে নিয়ে যায়। যা এখনকার হিসেবে কল্পনাতীত। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা নন্দদুলাল মন্দিরেও চালায় তারা লুন্ঠন । আজও সেই মন্দিরে কামানের গোলার দাগ সেই ধ্বংসের সাক্ষী বহন করে চলেছে।

               ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এই রাজবাড়ী, যেখানের সূক্ষ্ম কারুকাজে আজ লেগেছে কালের প্রলেপ। বাড়ির গঠনরীতি সত্যিই চোখ আটকে দেয়। রাজা নেই রাজত্বও নেই তবুও প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে আজও শোনা যায়,

    “মহাবিঘ্নে মহোৎসাহে মহামায়ে বলপ্রদে।

    প্রপঞ্চাসারে সাধ্বীশে জগদ্ধাত্রী নমোহস্তু তে।।”

শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো বারোয়ারী ভাবে হলেও আজও এই পুজোর সংকল্প হয় ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের নামে।

              রাজবাড়ীর ভিতরে গিয়ে রাজার পুজোর গল্প ও রাজার গল্প শুনে সত্যিই রূপকথার রাজাকে পেলাম অনুভূতির অনুভবে। শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়ির ইতিহাস কথা বলে আজও। বিশাল রাজবাড়ীর প্রতিটি কোণায় আজও আভিজাত্যের ঝলক। তেজ নেই কিন্তু রেশ রয়ে গেছে আভিজাত্যের সঙ্গে। আমার ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যায়,

    “অশথ উঠিয়াছে     প্রাচীর টুটি,

      সেখানে ছুটিতাম    সকালে উঠি।

   শরতে ধরাতলে       শিশিরে ঝলমল,

   করবী থোলা থোলা   রয়েছে ফুটি ।

      প্রাচীর বেয়ে বেয়ে   সবুজে ফেলে ছেয়ে

   বেগুনি-ফুলে-ভরা      লতিকা দুটি।

ফাটল দিয়ে আঁখি       আড়ালে বসে থাকি,

    আঁচল পদতলে        পড়িছে লুটি।।”

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সুমি ভট্টাচার্য্য

https://wordpress.org/news/

https://www.banglakhabor.in/%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b0-1-%e0%a6%a8%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%b0-%e0%a6%ab%e0%a7%81%e0%a6%9f%e0%a6%ac%e0%a6%b2-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ac-%e0%a6%ae/