‘’Remember, remember!/The fifth of November,’’
বিখ্যাত সেই ছড়া নিশ্চয়ই মনে আছে? জানেন কি, শিশুভোলানো এই ছড়ার পেছনেই লুকিয়ে আছে অনেক বিপ্লবের অঙ্কুর! ভারতের স্বাধীনতা দিবস হতে পারতো ১৯১৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। কেমন ছিল সেই পরিকল্পনা? কারা যুক্ত ছিলেন সেই ইতিহাসে? আজ আমরা জানব সেই অতীত। ক্রিসমাস মানেই আনন্দের মরশুম। বছর শেষের কটাদিন ভরে থাকে নতুন নতুন স্বপ্নের আশায়। যে স্বপ্নের গাঁথুনিতে রচিত হয় আগামী দিনের পথ । রচিত হয় ইতিহাস। তেমনই এক প্রসঙ্গ ক্রিসমাস ডে প্লট।
ক্রিসমাস ডে প্লট আমরা কি মনে রেখেছি? ফিরে দেখা যাক সেই দুঃসাহসিক ইতিহাস।
১৬০৫ সালের লন্ডন। প্রোটেস্ট্যান্ট রাজা জেমস তখন ক্ষমতায়। আর অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ক্যাথলিকদের নিয়ে দল তৈরি করছেন রবার্ট ক্যাটসবি। ৫ই নভেম্বর পার্লামেন্টের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে হাউস অফ লর্ডসে চলছিল উৎসব। উপস্থিত ছিলেন রাজা জেমস সহ অন্যান্য ক্ষমতাবান শাসকেরা, এমনকি চার্চ অফ ইংল্যান্ডের বিশপও। তাঁদের অজান্তে রবার্ট ক্যাটসবির দল পার্লামেন্টের নীচের কক্ষে সাজিয়ে রেখেছিল পিপের পর পিপে ভর্তি প্রচুর বারুদ। বিস্ফোরণের দিন ঠিক করা ছিল ওই উৎসবের দিনেই।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে বারুদে আগুন লাগাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান ক্যাটসবির দলের অন্যতম সদস্য গাই ফওক। হাউস অফ লর্ডস সে যাত্রা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও বিপ্লব ব্যর্থ হয়না। এই ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থেকে যায় ‘গান পাউডার প্লট’ নামে। স্মরণীয় হয়ে থাকে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে ও শিশুভোলানো ছড়ায়। এবং অবধারিতভাবে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার ঘটে। ৩০০ বছর পরেই, কলকাতায়।
‘’ Remember remember! 25th of December ‘’- না। এরকম কোনও ছড়া আবার বানানো হয়নি।এমনকি ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকেও ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে ক্রিসমাস ডে প্লট- এর ঘটনা। যার নায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বা আমাদের বাঘাযতীন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতির মতো অনেক গুপ্তচর গোষ্ঠীর উত্থান হয় যারা একের পর এক ইংরেজ অফিসারদের হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ধরা পড়ে যেতেন অনেকেই, তারপরও এই প্রচেষ্টার ত্রুটি রাখতেন না বাংলার বিপ্লবীরা।বাঘাযতীনের নেতৃত্বে ১৯১২ সালে স্বয়ং রাসবিহারী বসু ভাইসরয় হার্ডিঞ্জকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।যদিও কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে খুচরো আক্রমণ বড় কোনো বদল আনতে পারবেনা।
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চাই ঠিকঠাক পরিকল্পনা।যতীন্দ্রনাথ কলকাতার গুপ্তচর সমিতিগুলোকে মজবুত করার পাশাপাশি বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিভিন্ন জেলাতেও শাখা গড়ে তুললেন। উপযুক্ত সময়ের জার্মানির যুবরাজের কাছ থেকে অস্ত্র-সস্ত্র এবং গোলাবারুদের জোগান নিশ্চিত করলেন। বিশ্বযুদ্ধের বাতাবহে তখন পৃথিবী উত্তাল। ইংল্যান্ডের উপনিবেশ হিসেবে ভারতেও যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছে।জার্মান শিবির ভারতের সঙ্গে মিত্রতা রেখেই চলছিল বরাবর। কারণ ইংরেজ তাদেরও শত্রু।
প্রথম ক্রিসমাস ডে প্লট ছিল ১৯০৯ সালের ঘটনা। বাংলার বিপ্লবীরা সেই প্রথম এক বিপুল ষড়যন্ত্র সফল করতে চলেছিল।বছর শেষের ছুটিরদিনে বাংলার গভর্নর তাঁর নিজ বাসভবনে একটি নৈশভোজের পার্টির আয়োজন করলেন। তৎকালীন ভাইসরয়, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং রাজধানীর (কলকাতা) সকল উচ্চপদস্থ ইংরেজ অফিসারদের উপস্থিতিতে ২৫ শে ডিসেম্বরের বলরুম জমজমাট।সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলেন দশম জাট রেজিমেন্ট।সেই নাচগানের আসরেই সমস্ত ব্রিটিশ শত্রুকে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অধীনের বিপ্লবী সৈন্যরা।কিন্তু গাই ফওকের মতই জনৈক বিপ্লবী ধরা পড়ে যাওয়ায় সমগ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
ভন ক্লেম, লোকমান্য তিলকের বন্ধু, ১৯১০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি, সেন্ট পিটার্সবার্গকে লিখেছিলেন যে এটি “দেশের জনজাগরনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।সাধারণ মনের বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠলেই বিপ্লবীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।”
দ্বিতীয় ক্রিসমাস দিবসের চক্রান্তটি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই। বাঙালি ভারতীয় বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথের অধীনে সেজে উঠেছিল যুগান্তর সমিতি। জার্মানি থেকে নিয়মিত আসত সহায়তা।ততদিনে বার্লিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গদর পার্টি।বাংলার গুপ্তসমিতিগুলোর সঙ্গে সংযোগ রেখে একাধিক গোষ্ঠীর শাখা কাজ করে চলেছিল জার্মানি থেকে।
১৯১৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর পরিকল্পনা হল দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডের।গদর পার্টির নির্দেশে, বার্মার ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং সিয়াম রাজ্যের জার্মান এজেন্টরা একযোগে অভ্যুত্থান সমন্বিত করার জন্য যুগান্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয় মাদ্রাজ শহর এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ব্রিটিশ দণ্ডবিধির উপর একটি জার্মান অভিযানের পরিকল্পনাও।পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং বাঘাযতীন। লক্ষ্য ছিল প্রথমেই ফোর্ট উইলিয়াম তারপর বাংলাকে উপনিবেশের বাইরে এনে রাজধানী কলকাতা নিজেদের দখলে আনা; যা তখন সর্বভারতীয় বিপ্লবের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত হত।
ক্রিসমাস ডে প্লটটি যুদ্ধের সময় সর্বভারতীয় বিদ্রোহের পরবর্তী পরিকল্পনাগুলির মধ্যে ছিল অন্যতম।পরিকল্পনা সফল করতে বাংলা, বার্মা, বাটাভিয়া (যা এখনকার জাভা) থেকে শুরু করে আন্দামান নিকোবর অবধি একযোগে কাজ করে চলছিলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জার্মান এবং ভারতীয় ডাবল এজেন্টদের মাধ্যমে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এই প্লটটি চূড়ান্তভাবে অনাবৃত করে ফেলেন।ফলত পরিকল্পনা ব্যর্থ হল আবারও।
১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বালেশ্বরে বুড়ি বালামের উপকন্ঠ্যে যুদ্ধ করতে করতে গ্রেপ্তার হলেন বাঘা যতীন।পরদিন সরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। রক্তবমি করতে করতে মারা যাবার খানিক আগে বলেছিলেন; “ এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।”
বাঘা যতীন যেভাবে ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে, ৩০০ বছর আগে ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল রাজদ্রোহী গাই ফওকের ক্ষেত্রে। কিছু হেরে যাওয়া হয়ত চিরন্তন এবং একইরকম। সেগুলো ঠিক ছিল না ভুল তার বিচার করে সময় কিন্তু বিপ্লবীরা থেকে যান ইতিহাসের পাতায়। তাঁরা হয়ে ওঠেন চিরকালীন প্রতিবাদের মুখ। গান পাউডার প্লট হোক কিংবা ক্রিসমাস ডে প্লট, যেকোনো আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে আমরা চিনে উঠতে পারি সরু গোঁফওয়ালা, টানা চোখের একটি সাদা মুখোশ যা প্রতীকী হিসেবে আজও ব্যবহৃত হয়।
সেই মুখ দেখে থাকবেন টিনটিনের ‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’ বিপ্লবীদের মুখে, কখনও ‘ভি ফর ভেন্ডেটা’য় নৈরাজ্যবাদীর চেহারায় আবার কখনও “বেলা চাও’’ -এর সুরে সাল্ভাদোর দালির ছদ্মবেশে; আর কখনো কখনো আমার আপনার বাস্তবের রাস্তায়, রাজপথের মধ্যিখানে।
“We are told to remember the idea and not the man. Because a man can fail. He can be caught, he can be killed and forgotten. But 400 years later, an idea can still change the world. ‘’
― Alan Moore, V for Vendetta
[…] 25শে ডিসেম্বর ক্রিসমাসেই হতে পারতো ভার… […]