“যা নেই মহাভারতে/ তা নেই ভূ ভারতে।”
এরকম একটা কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। বিশ্লেষণ করলে দেখবো যে এই প্রবাদটি সম্পূর্ণ সঠিক। পৃথিবীর যে কোনো মহাকাব্য তৎকালীন সময়-সমাজকে তুলে ধরে, বলে এক বৃহৎ রাজনীতির কথা। কিন্তু মহাভারতের মতো এতো পুঙ্খানু পুঙ্খভাবে রাজনীতি নিয়ে চর্চা এবং বিশ্লেষণ আর কোনো মহাকাব্য করেছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সবচেয়ে বড় কথা মহাভারতের রাজনীতির যা যা প্রকার দেখানো হয়েছে তা আজও ঘটে চলেছে ভারত তথা সারা বিশ্বে।
তাহলে কি মহাভারতকে ভবিষৎ দ্রস্টা বলবো ? না, মহাভারত ভবিষ্যৎ রচনা করেননি। তা করাও যায় না। আসলে এটি রাজনীতির যাবতীয় গতিপ্রকৃতি ও তার মোচড়কে সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিল। আর রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অতীতে যা ছিল, বর্তমানেও তাই আছে। শুধু নাম বদলেছে, বদলেছে কিছু পদ্ধতি। সেই একই সুপ্রিমেসি, উত্থান-পতন আজও হয়ে চলেছে।
মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন বলে আমরা জানি। মহাভারতে বলা হয়েছে মহর্ষি বেদব্যাস মুখে মুখে ঘটনা বলছিলেন এবং গণেশ তা লিখেছিলেন। গণেশ, অর্থাৎ শিব-পার্বতীর সন্তান। ঠিকই হিন্দু পুরাণে গণেশের জন্ম নিয়ে অনেক রকম মত আছে আর আমরা তার মধ্যে এখন ঢুকছি না। কারণ আমরা আজ মহাভারতের অন্য একটি দিকের ওপর দৃষ্টিপাত করব।
কৃষ্ণকে মনে করা হয় মহাভারতের যাবতীয় রাজনীতির মূল কাণ্ডারী। ধর্মীয় আবেগকে পাশে সরিয়ে রাখলে দেখা যাবে গোটা বিষয়টি একদম ঠিক। আবার যদি পৌরাণিক সংযোগ খুঁজতে চাই তাতেও এটার যথার্থতা প্রমাণ হবে। কারণ বিষ্ণুর মানব অবতার ছিলেন কৃষ্ণ। এছাড়া অর্জুন ভীমের মতো নায়কদের কথা তো আমরা খুবই পরিষ্কার করে জানি। বলিউডি সিনেমার ভাষায় “মহাভারতের খলনায়ক কারা” সেটাও আমরা জানি। সত্যি কি তা জানি? প্রশ্ন আছে। কারণ দূর্যোধন ও দূঃশাসনের বাইরে আর কাউকে খলনায়ক বলে খুব একটা কোনোদিনই মনে করিনি আমরা। অথচ এই দু’জনের বাইরে আরো অনেক খলনায়ক আছে গোটা মহাভারত জুড়ে। আমরা আজ দুর্যোধন এবং দুঃশাসন ব্যতীত মহাভারতের বাকি ব্যতিক্রমী খলনায়কদের নিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করবো।
১) ভীষ্ম
এই তালিকায় ভীষ্মের নাম দেখে অনেকেই চমকে উঠবেন। সেটা স্বাভাবিক। কারণ আপাতভাবে মানুষজন ভীষ্মকে মনে করেন একজন সত্যনিষ্ঠ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মহান বৃদ্ধ হিসাবে। যিনি বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করে আর সারা জীবন ঘর-সংসার করেননি। বাবা এবং বিমাতার কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ থাকায় তিনি আজীবন হস্তিনাপুরকে রক্ষা করে গিয়েছেন, যা আমাদের কাছে অত্যন্ত মহান পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছে বারেবারে।
অথচ ভেবে দেখুন তো ব্যক্তিগত এই যাবতীয় বিষয়গুলিকে এতটা কি গুরুত্ব দেওয়া উচিত? প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিজ্ঞা যেমন ভালো বিষয়, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি বা প্রতিজ্ঞাকে অজুহাত করাটা কখনোই মহৎ কার্য হতে পারে না। বরং তা কখনো কখনো অন্যায়ের প্রধান সহায় হয়ে ওঠে! যখন কৌরব রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হল এবং তাকে প্রায় বেশ্যা বলেই দেগে দিলো দূর্যোধন সহ তার ভাই এবং বন্ধুবান্ধবরা, তখন কি একবারও প্রতিবাদ করেছিলেন ভীষ্ম? করেননি। তিনি হয়তো মনে করেছিলেন যেহেতু হস্তিনাপুরের রাজা সিংহাসন রক্ষা করার জন্য তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই শত অন্যায় তার চোখের সামনে ঘটলেও, মনের অভ্যন্তরে যতই রক্তক্ষরণ হোক মন বেদনায় যতই পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক, হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনের প্রতিনিধি দুর্যোধনের কার্যকলাপের বিরোধিতা করা ঠিক হবে না!
অথচ এই ভীষ্মর এমন ক্ষমতা ছিল চাইলে একার হাতে এই অন্যায় থামিয়ে দিতে পারতেন। ১২ বছর বনবাস এবং ১ বছর অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে পাণ্ডবরা ফিরে এসে যখন তাদের ইন্দ্রপ্রস্থ দাবি করল, তখন দুর্যোধন তা দিতে অস্বীকার করে। হ্যাঁ সেই সময় ভীষ্ম দুর্যোধনকে নরমে-গরমে অনেকবার বুঝিয়েছিলেন রাতে সে পান্ডবদের রাজ্য তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু ওইটুকুই। অথচ তিনি চাইলেই দুর্যোধনকে বাধ্য করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। সেই একই অজুহাতে আবারও এক অন্যায় করলেন তিনি মহতি ভীষ্ম।
অনেকের মনে হতে পারে ভীষ্ম মহান ত্যাগী। ঠিক, তিনি ত্যাগী। কিন্তু এই ত্যাগ হস্তিনাপুরের নামে করলেও তা ছিল কেবলমাত্র ব্যক্তিগত মহত্ত্বের প্রচেষ্টা। বলা যেতে পারে নিজেকে মহৎ করে তোলার বাসনা পেয়ে বসেছিল ভীষ্মকে। তিনি প্রকৃত ন্যায় বা সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে গোটা বিষয়টি মোটেও দেখেননি। দেখলে কখনোই এতো অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। পারতেন না নিজের কুলো বধুর এই বিপুল লাঞ্ছনা দেখেও চুপ করে থাকতে। তাই আমাদের মতে ভীষ্ম মহাভারতের অন্যতম খলনায়ক। রবি ঠাকুরের লাইন ধার করে এক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে
“অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।”
ভীষ্ম নিজহস্তে অন্যায় না করলেও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে একই রকম অপরাধ করেছেন।
২) গুরু দ্রোণ
মহাভারত থেকে জানা যায় ভরদ্বাজ মুনির পুত্র দ্রোণের জন্ম হয়েছিল একটি কলসির ভেতর। দ্রোণ শব্দের অর্থ “কলস” বা কলসি। ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে দ্রোণ এবং দ্রুপদের (যিনি পরবর্তীকালে বিখ্যাত রাজা হবেন এবং দ্রৌপদী যার কন্যা) একত্র শিক্ষালাভ এবং পরবর্তী পর্যায়ে দ্রুপদ কর্তৃক দ্রোণের বন্ধুত্ব অস্বীকারের ঘটনা এসব সবাই জানে। পরবর্তীকালে তিনি পান্ডব এবং কৌরবদের কিভাবে অস্ত্রগুরু হয়ে উঠলেন এবং তার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অর্জুন কেমন করে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়ে উঠলো তাও প্রায় সবাই জানে। এসব ঘটনার গল্প করার কোনো মানে হয় না, বরং মূল বক্তব্যে মন দিই আমরা।
পান্ডব এবং কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা সুশিক্ষিত করে তুলে সফল গুরু হিসাবে দ্রোণ পরিচিত হলেন দ্রোণাচার্য নামে। তিনি হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন ঠিক ভীষ্মের মতো। আর সেই প্রতিশ্রুতিকে হাতিয়ার করে তিনিও দুর্যোধন এবং তার সঙ্গী সাথীদের একের পর এক অন্যায় ও অপরাধকে মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছে। কোনো প্রতিবাদ করেননি। মুখে দু’চারটে কথা বলাকে কোনো প্রতিবাদ বা দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া বলে না, যখন উল্টোদিকের মানুষটির ক্ষমতা আছে অন্যায়টাকে রোধ করে দেবার।
তার কন্যা সম দ্রৌপদীকে যখন হস্তিনাপুরের রাজসভায় তারই সম্মুখে বিবস্ত্র করা হচ্ছিল তখন দ্রৌপদী তার কাছে হাতজোড় করে সম্মান রক্ষা করার অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস, মৌন হয়ে ছিলেন দ্রোণাচার্য! এই সেই দ্রৌপদী যে তার প্রিয়তম শিষ্য অর্জুনের স্ত্রী। যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অন্যায় ভাবে বালক অভিমুন্যকে হত্যা করা হচ্ছিল তখনও কোনো প্রতিবাদ করেননি তিনি। তার চোখ দিয়ে জল পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এত বড় অন্যায় রুখে দেননি তিনি।
মহাভারতের অনেক জায়গাতেই দেখা যাবে বারে বারে তার নিরবতার পক্ষে অজুহাত খাড়া করতে গিয়ে নিজের পুত্র অশ্বথামার প্রতি অন্ধ স্নেহের কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন গুরু দ্রোণ। অর্থাৎ পুত্র-স্নেহে অন্ধ হয়ে তিনিও ধৃতরাষ্ট্রের মতোই একের পর এক অন্যায় কাজ ঘটে যেতে দিয়েছেন। যার মানে দাঁড়ায় অন্যায়ের সঙ্গে প্রতিপদে আপস করতে করতে নিজের অজান্তেই সেই সমস্ত অন্যায়ের শরিক হয়ে গিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। তাই তিনিও একই রকমভাবে খলনায়ক।
৩) বলরাম
এই নামটা তালিকায় দেখে কেবলমাত্র চমকে যাওয়া নয়, ছিটকে যেতে পারেন মানুষজন। কারণ কৃষ্ণ যেমন বিষ্ণুর অবতার, তেমনি বিষ্ণুর বাহন শেষ নাগের অবতার ছিলেন বলরাম সংকর্ষণ। অন্তত তেমনি দাবি করা হয়েছে মহাভারতে। সেই বলরাম কিভাবে খলনায়কদের অন্যতম একজন হয়ে উঠলেন তা সত্যিই বিস্ময় সূচক!
আমরা বরং মূল বিষয় ঢুকি এবার। এমনিতে মহাভারতে বলরাম অর্থাৎ কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার খুব একটা ভূমিকা কখনোই চোখে পড়েনি। তাহলে তিনি কি করে খলনায়ক হলেন? মজাটা এখানেই। অর্জুন যখন সুভদ্রাকে বিয়ে করতে চায় তখন বলরাম যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন। সুভদ্রাও কিন্তু অর্জুনকেই ভালবাসতেন। তবু তিনি অহেতুক জেদের বশে কৃষ্ণের পরামর্শ না মেনে তাদের বিয়েতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আচ্ছা ধরে নিলাম তা ছিল একজন দাদার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু এই বলরাম চেষ্টা করেছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ যাতে পান্ডবদের পক্ষে না থাকে। অথচ তিনি যাবতীয় ঘটনাই জানতেন। কুন্তী ছিলেন তার আপন পিসি। তাহলে বলরাম এই বিরোধিতা করেছিলেন কেন? এর মূল কারণ তিনি দুর্যোধনকে শীষ্য হিসাবে খুবই ভালবাসতেন। তাই চাননি এমন কোনো পদক্ষেপ যাদবদের দিক থেকে নেওয়া হোক যার ফলে দুর্যোধন বিপাকে পড়তে পারে।
এখানেই শেষ নয় আরও আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে লড়াই একেবারে শেষের দিকে, ভীম দুর্যোধনের উরুতে গদা দিয়ে আঘাত করে দিয়েছে এবং দুর্যোধন মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে, তা দেখে বলরাম ভীমকে হত্যা করতে এগিয়ে যান। তার যুক্তি ছিল গদাযুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী কোমরের নিচে যেহেতু আঘাত করা যায় না তাই দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে ভীম নিয়ম ভেঙেছেন। এই কারণ হেতু তিনি ভীমকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন।
ঠিক, ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করেছিলেন। কিন্তু এই দুর্যোধন যখন তার নিজের ভাগ্না অভিমুন্যকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল তখন তিনি কিন্তু প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেননি! এই দুর্যোধন যখন বছরের পর বছর ধরে পান্ডবদের লাঞ্ছিত করে গিয়েছিল তখনও তিনি এগিয়ে আসেননি। অথচ তার প্রিয়তম শিষ্যের উরুতে ভীম প্রতিজ্ঞা মতো গদা দিয়ে আঘাত করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। এই ঘটনা মোটেও ন্যায় সম্মত তো নয়ই, বরং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোনো অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন যে ব্যক্তিই করেন তাকে অপরাধী বা খলনায়ক বলেই সমাজে মনে করা হয়।
৪) অশ্বথামা
অশ্বথামা হলো গুরু দ্রোণাচার্যের একমাত্র পুত্র। তার ক্ষেত্রে আমরা আলাদা কোনো পরিচয় বা ব্যাখ্যায় যাবনা। শুধু এইটুকু বলে রাখা দরকার জন্ম থেকেই তিনি বড্ড বখে যাওয়া ছেলেদের মতোই আচরণ করতেন, কথায় কথায় বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করাটা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে অশ্বত্থামা যে পাপ বা অপরাধ করেছেন তা বোধহয় দূর্যোধন পর্যন্ত করেনি!
আপনার যাবতীয় রাগ, জীঘাংসা, শত্রুতা যে ব্যক্তির ওপর তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে আপনি যদি সেই ব্যক্তির সন্তানকে হত্যা করেন, তবে আপনার মতো হীন মানুষ এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আর আপনার এই ক্রোধ আক্রোশ যদি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার আগেই গর্ভস্থ কাউকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার দিকে আপনাকে পরিচালিত করে তখন কী বলা হবে আপনাকে? সম্ভবত সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। যাবে না কারণ তা বুঝে ওঠার মতো কোনো শব্দ আছে বলেই মনে করি না!
এই মহাপাতক অশ্বত্থামা পান্ডবদের বংশধর স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য অভিমুন্যর স্ত্রী উত্তরার গর্ভস্থ ভ্রূণকে পর্যন্ত ব্রহ্মশীর অস্ত্র দ্বারা হত্যা করেছিল। এছাড়াও নির্বোধের মতো দ্রৌপদীর পাঁচ নাবালক পুত্রকে হত্যা করে সে। তবে এই মহা পাপী তার উপযুক্ত শাস্তি হিসাবে পেয়েছিল অমরত্বের অভিশাপ! সবাই যখন অমরত্ব ক আশীর্বাদ স্বরূপ দেখে, তখন এই মহাপাপী অশ্বত্থামা বুঝেছিল অমরত্ব কত বড় অভিশাপ হতে পারে! তার মতো উশৃঙ্খল খলনায়ক মহাভারতে আর কেউ নেই।
৫) কর্ণ
কর্ণ “দাতা কর্ণ” রূপে মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। এটা খুবই সত্যি ঘটনা। সেই সঙ্গে তার গোটা জীবনের চলন মহাভারত পড়া প্রতিটি মানুষের হৃদয়কেই বোধহয় আর্দ্র করে তোলে, মন ব্যথাতুর হয়ে ওঠে কর্ণের দুঃখে। তিনি আজীবন সত্যনিষ্ঠা এবং ন্যায়ের পথে চলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো দুর্যোধনের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ। আর এই কারণেই তিনি না চাইলেও একাধিক অপরাধের শরিক হয়ে পড়েছিলেন।
বর্তমান দলীয় রাজনীতির পদ্ধতি মেনেই কর্ণ দুর্যোধনের একাধিক দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই সমস্ত কাজের শরিক হয়ে পড়তেন। উদাহরণ অজস্র। তাই সবগুলো নিয়ে কথা বলবো না, আমরা মাত্র দুটি উদাহরণ দিয়ে গোটা বিষয়টি বিশ্লেষণ করবো যে কিভাবে খলনায়ক হয়ে উঠেছিলেন কর্ণ।
বরাবরই দ্রৌপদীর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এসেছেন কর্ণ। কৌরব রাজসভায় যখন দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা হচ্ছিল তখন দুর্যোধনের সঙ্গ দিয়ে তিনি দ্রৌপদীকে বেশ্যা বলে কটূক্তি করেন, অথচ বস্ত্রহরণের কোনো প্রতিবাদ করেননি তিনি। অন্যদিকে অভিমুন্যকে যখন ঘিরে ধরে দুর্যোধন দুঃশাসন অশ্বত্থামারা প্রহার করতে শুরু করে তখন কর্ণ একবার মৌখিকভাবে এই আচরণের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু দূর্যোধন তাকে অভিমুন্যকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি যাবতীয় ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বাকিদের সঙ্গে অভিমুন্য হত্যা যজ্ঞে মেতে ওঠেন।
কর্ণের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ ছিল না তা কিন্তু নয়, বরং তা অনেকের থেকেই অনেক বেশী মাত্রায় ছিলো। এরকম একজন সচেতন মানুষ যে কারণেই হোক অন্যায়ের সঙ্গে যখন দেয় তার চেয়ে অবমাননাকর আর কিছুই হতে পারে না। তাই যতই দাতা কর্ণ মহত্ত্বের নিদর্শন হোক না কেন, মহাভারতে তিনি আসলে খলনায়কের ভূমিকাই পালন করেছেন।
দূর্যোধন ও দুঃশাসন ব্যতীত এই পাঁচ খলনায়কের তালিকা দেখে অনেকেই মুচকি হাসতে পারেন, কারণ শকুনি যে নেই এই তালিকায়! দুর্যোধনের মামা শকুনিকে নিয়ে ইচ্ছে করেই এখানে আমরা আলোচনা করিনি। কারণ তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যোপান্ত পাপো অন্যায় নিমজ্জিত। ষড়যন্ত্রে করা আসলে ছিল শকুনির খেয়াল। মহাভারতে কৃষ্ণের প্রতিচ্ছবি ছিলেন বোধহয় শকুনি। কৃষ্ণ ছিলেন “সু” এর সঙ্গে, আর শকুনি ছিলেন “কু” এর সঙ্গে। এটুকুই যা পার্থক্য এবং এটাই আসলে মূল পার্থক্য! আমরা এখানে মূলত তাদের নিয়েই আলোচনা করলাম যাদেরকে সাধারণ মানুষ খলনায়ক নয়, বরং অবহেলিত নায়কের দৃষ্টিতে এতদিন দেখে এসেছেন।
মহাভারত বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝেছি এই আলোচিত পাঁচ জন ব্যক্তি সম্বন্ধে অনেক সময় নায়ক বলে ভ্রম সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত খলনায়কের ভূমিকাই পালন করেছেন তারা। এদের বাইরে আরও অজস্র অজস্র খলনায়ক থেকে গিয়েছেন যাদের চিনে নেওয়া খুব একটা কঠিন নয়। তাই তাদেরকে নিয়ে আর আলোচনায় অবতীর্ণ হইনি আমরা।