উনিশের লোকসভা ভোটের পর থেকে রাজ্য রাজনীতিতে একটি কথা খুব প্রচলিত হয়েছে ‘বামে পুঁটকি পড়ে সব ভোট রামে গিয়েছে’। এই মন্তব্য নিয়ে বামপন্থীদের রীতিমতো আপত্তি আছে। কিন্তু বাস্তব হল প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের দিক থেকে ঘুরে গিয়ে বিজেপির বাক্সে জমা হয়েছিল। সেই ভোটের ওপর ভর করেই একুশে বাংলায় ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। কিন্তু রাজনীতি যেহেতু সরল পাটিগণিত নয়, তা বরং জটিল কেমিস্ট্রির বিষয় তাই বিজেপি তাদের এই ভোট ধরে রাখতে পারবে এরকম নিশ্চয়তা নেই। অনেক জটিল যোগ বিয়োগের অঙ্ক এবারে ঘটতে পারে। এই কেমিস্ট্রির ওপর নির্ভর করে অঙ্কের যে হিসেব শেষ পর্যন্ত তৈরি হবে তাই নির্ধারণ করবে একুশের বিধানসভা ভোটে কারা সরকার গড়বে।

ভোটের ফল কি হবে তা এখন বলা কোন‌ও মতেই সম্ভব নয়। এর জন্য ফল প্রকাশের দিন অর্থাৎ ২ মে পর্যন্ত আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচার যদি কোনও ইঙ্গিত হয় তবে সরকারি দল অর্থাৎ তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ যেমন তুঙ্গে উঠেছে, তেমনি বিজেপি বিরোধী মনোভাব ক্রমশ তীব্র হচ্ছে রাজ্যবাসীর একাংশের মধ্যে। এর পাশাপাশি বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ এর যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত মোর্চাও অনেকটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিরোধী সংখ্যালঘুদের একটা অংশও বেশ কিছু জায়গায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। এবারের হিসেবে একটা বিষয় পরিষ্কার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন‌ও ভোট যে তারা পাবে না সে বিষয়ে বিজেপি একেবারে নিশ্চিত।

যেটুকু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট গেরুয়া শিবির পেয়েছিল তা এবার তৃণমূল বিরোধী অবস্থান বজায় রেখে সংযুক্ত মোর্চার ঝুলিতে আসতে চলেছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এর পাশাপাশি বামেদের দুর্বল দেখে তৃণমূল বিরোধী একটা বড় অংশ ২০১৯এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ওপর আস্থা রেখেছিল। এবারে তারা আবার পুরানো জায়গায় ফিরতে পারে। কারণ সংযুক্ত মোর্চা ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভোট ময়দানে। তাই সব মিলিয়ে এটুকু বলা যায় বাম ভোট রাম থেকে আবার বামে ফিরলে আখেরে ক্ষতি বিজেপির। সেক্ষেত্রে গেরুয়া শিবির বিরল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

আমরা বরং একটু তলিয়ে দেখি ঠিক কী কী কারণে বামেদের ভোট আবার ঘরে ফিরে আসতে পারে।


[  ]  আইএসএফ ফ্যাক্টর-

রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট যে এবার তৃণমূল এবং সংযুক্ত মোর্চার মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে তা একরকম নিশ্চিত। ২০০৯ লোকসভা ভোট থেকে এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সমর্থন মূলত একচেটিয়াভাবে পেয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই তৃণমূল বিরোধী একটি অংশ ছিল। তারাই উনিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপিকে ভোট দেয়। কিন্তু ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী নিজের রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট গঠন করার পর কেবলমাত্র তৃণমূল বিরোধী নয়, তৃণমূলের ভোটের একটা বড় অংশ ছিনিয়ে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আব্বাসের দলকে নিয়ে জোট গঠন করায় সেই সুফল বামেরাও পাবে। এতে কপাল পুড়বে বিজেপির।


[  ]  অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর-

দশ বছর সরকার চালানোর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষোভের পাশাপাশি তৃণমূলের নিচুস্তরের নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সেই সঙ্গে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিও অনেকে পছন্দ করছেন না। এই দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে একটা বড় অংশের ভোট তৃণমূল এবং বিজেপির দিক থেকে বামেদের ঘরে ফিরে আসতে পারে। তাতে তৃণমূলের যেমন ক্ষতি হবে তেমনি হাত পুড়বে বিজেপির।


[  ]  প্রাক্তন তৃণমূলীদের মঞ্চ বিজেপি-

তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের একটা বড় কারণ হল তাদের নেতাদের লাগামছাড়া দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য। কিন্তু মুকুল রায় থেকে শুরু করে হালের গণ্ডায় গণ্ডায় তৃণমূল নেতা ও বিধায়ক বিজেপিতে গিয়ে হাজির হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণে তৃণমূলকে উচিত শিক্ষা দিতে বামেদের অনুগত ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, তাদের অনেকের মনেই গেরুয়া শিবির সম্বন্ধে মোহভঙ্গ ঘটেছে। সেই ভোট তৃণমূলের বদলে বামেদের ঘরে ফিরে আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল।


[  ]  সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা-

এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের তথাকথিত প্রগতিশীল একটি অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলমান তোষণের বিষয়ে যেমন বিরক্ত, তেমনি বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়েও তারা অত্যন্ত আতঙ্কিত। সেই অংশের ভোট তৃণমূলের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একসময় বিজেপিতে গিয়ে হাজির হয়েছিল। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় বাংলায় জমি তৈরি করার জন্য বিজেপি তাদের সাম্প্রদায়িক মুখ নিয়ে খুব একটা হাজির হয়নি। কিন্তু যেই বাংলা জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে অমনি গেরুয়া শিবির পরিষ্কার মেরুকরণের তাস খেলে বাংলা দখল করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রগতিশীল অংশ বামেদের দিকে ফিরে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে জোট একটু হলেও কাঁটা হয়ে বামেদের বিঁধছে।


[  ]  ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠা-

সাধারণ ভোটারদের মধ্যে একটা প্রবণতা থাকে আমার ভোট যেন নষ্ট না হয়। সেই জন্য অনেক সময় যে দলের মতাদর্শের প্রতি তাদের সমর্থন, তাকে ভোট না দিয়ে যে পক্ষের জয়লাভের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তাদেরকে ভোট দেন সাধারণ মানুষ। মূলত এই কারণেই উনিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ঠেকাতে বামেদের ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল। কিন্তু বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এবং ভোটের ফল প্রকাশের পর রাজ্যে ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি তৈরি হবে এই সম্ভাবনা মাথাচাড়া দেওয়ায় অনেক হারানো ভোট ফিরে পেতে পারে বামেরা। কারণ সরকার গড়ার হিসেব থেকে বা সরকারের মূল নিয়ন্ত্রক হওয়ার ক্ষেত্রে তারাও যথেষ্ট ভালোভাবে লড়াইয়ে আছেন। তাই তৃণমূল বিরোধী ভোট এবার যে পুরোটাই বিজেপির ঘরে গিয়ে জমা হবে না মোটেও। বরং তাদের হারানো ভোট বেশ অনেকটাই উদ্ধার করতে পারবে বামেরা।


সবশেষে একটাই কথা বলার রাজনীতি বিচিত্র সম্ভাবনার খেলা। তাই ভোটের ফল প্রকাশের আগে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এক ঝাঁক তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিত প্রার্থী দিয়ে এবং প্রচারে ঝড় তুলে বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা ভোটের রাজনীতির ময়দানে অনেকটাই প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করলে সরকার বিরোধী পক্ষ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিজেপি।

বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ দফার নির্বাচনে যে সমস্ত কেন্দ্রগুলোতে ভোট হচ্ছে সবগুলোই কমবেশি সংখ্যালঘু প্রভাবিত কেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই এই দফায় ভোট রাম থেকে বামে ফিরলে বিজেপির ফল শুধুমাত্র খারাপ নয়, প্রায় এই অঞ্চল থেকে মুছে যেতে পারে গেরুয়া শিবির।