মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলের সঙ্গে আরব প্যালেস্টাইনের দ্বন্দ্ব অতিপরিচিত ঘটনা। এই জায়ানবাদী রাষ্ট্রটির গতকাল অর্থাৎ ১৪ মে স্বাধীনতা দিবস ছিল। কিন্তু এ বছর আর শান্তিতে দিনটা কাটেনি তাদের। প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডের সঙ্গে তাদের প্রায় পুরোদস্তুর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গোটা দিন অতিবাহিত হয়। অবশ্য ১৯৪৮ সালের ১৪ মে রাষ্ট্রসংঘ ইজরায়েল গঠনের সরকারি ঘোষণা করার পর থেকেই এ অতিপরিচিত ছবি।
যদিও বারবার অভিযোগ উঠেছে ইজরায়েলে সামরিক শক্তির দম্ভে প্যালেস্টাইনের মানুষের উপর আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। ইহুদিবাদী ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা প্যালেস্টাইনের মানুষের জীবন নরক করে তুলেছে। না তাদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে বাঁচতে দিচ্ছে, না তাদেরকে নিজেদের জমিতে থাকতে দিচ্ছে। সম্প্রতি যে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে সেটা জেরুজালেমের আরব পাড়া থেকে একদল প্যালেস্টাইনের মানুষকে জোর করে উচ্ছেদ করতে চাওয়ার ঘটনাকে ঘিরে।
কিন্তু অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হল ১৯৪৮ সাল থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের মানুষের সমস্যার জন্য আরব দেশগুলো যেভাবে একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেটা দীর্ঘদিন ধরেই আর দেখা যাচ্ছে না। এবারে তো সামান্য বিবৃতি দিয়ে দায় সেরে ফেলা ছাড়া গাজা ভূখণ্ডের জন্য একটিও আরব দেশ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু হঠাৎ করে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, এর পিছনে অনেক গভীর রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিষয় লুকিয়ে আছে। আজ আমরা এইগুলোই খুঁজে দেখব। দেখব কেন প্যালেস্টাইনের আরবদের পাশ থেকে সরে গেল অন্যান্য আরব দেশগুলি।১) মেহেমুদ আব্বাসের ব্যর্থতা-
প্যালেস্টাইনের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমানে অতি বিচিত্র। ইজরায়েলের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পশ্চিম তীর বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্বদিকে অবস্থিত গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে সরাসরি কোনও সংযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ফাতাহ দলের মেহেমুদ আব্বাসের হাতে। তিনি সরকারিভাবে সমগ্র প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। যদিও গাজা ভূখণ্ডের উপর তার তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বলা চলে।
এই ফাতাহ গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবেই প্যালেস্টাইন আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইয়াসের আরাফাত। তার উত্তরসূরি হিসেবে মেহেমুদ আব্বাস এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। উল্টে তার এবং বাকি ফাতাহ নেতাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে অজস্র দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা প্যালেস্টাইনের স্বাধীকার রক্ষার প্রশ্নে ইজরায়েল এবং আমেরিকার সঙ্গে আপোষের পথ বেছে নিয়েছে।
প্যালেস্টাইনের কট্টরপন্থী আরবদের অভিযোগ নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রাখার স্বার্থে মেহেমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ বর্তমানের সম্পূর্ণভাবে আপোষের পথে হাঁটছে। তাদের কাছে স্বাধীন প্যালেস্টাইনের দাবি ও আবেগ আজ আর কোনও গুরুত্ব রাখে না। এই কারণেই গাজা ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব যাদের হাতে আছে সেই সশস্ত্র হামাসের সঙ্গে ফাতাহের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। দেশের এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বলতে গেলে সম্পর্ক তেমনভাবে নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেহেমুদ আব্বাসের এই ব্যর্থতা গোটা প্যালেস্টাইন আন্দোলনের গুরুত্বকেই অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
২) গাজা ভূখণ্ড হামাসের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা-
গাজা ভূখণ্ডের যাবতীয় কর্তৃত্ব যাদের হাতে সেই হামাস একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। বলা ভালো জঙ্গিগোষ্ঠী। শুধুমাত্র ইজরাইল ও আমেরিকা নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাতাতেও হামাস জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সেই কারণে কোনও আরব রাষ্ট্র প্রকাশ্যে হামাসের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন হতে হবে।
৩) মুসলিম ব্রাদারহুড সংযোগ-
গোটা আরব দুনিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বলা ভালো আরবের বর্তমান শাসকদের কাছে মুসলিম ব্রাদারহুড একটি অশনি সংকেত। মূলত মিশরে এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকলেও তারা আসলে ইসলামিক সৌভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে আরব শেখ, রাজাদের সিংহাসনচ্যুত করে শরীয় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মুসলিম ব্রাদারহুড এই মুহূর্তে মিশরের নিষিদ্ধ হলেও তার বিস্তার সমগ্র আরব দুনিয়াব্যাপী। সেই মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রত্যক্ষ সমর্থন আছে হামাসের প্রতি। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বার্থে জর্ডন, সৌদি আরব সহ বাকি আরব দেশগুলো এখন আর প্যালেস্টাইনের সঙ্গে সক্রিয় সম্পর্ক রাখতে চায় না।
বলা যেতে পারে মুসলিম ব্রাদারহুড সংযোগ হামাস বৈরিতার অন্যতম কারণ বাকি আরব রাষ্ট্রগুলির কাছে। তারা বরং খুশীই হয় ইজরায়েল যখন হামাসের উপর আক্রমণ করে। এই আরব রাষ্ট্রগুলো চায় হামাস একেবারে মুছে যাক মধ্যপ্রাচ্যের বুক থেকে। এই রাজনৈতিক বিষয়টিও প্যালেস্টাইন আন্দোলন থেকে বাকি আরব রাষ্ট্রগুলোর হাত গুটিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ।
৪) আমেরিকার ভূমিকা-
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, মিশর, জর্ডন, কুয়েত সহ বাকি সমস্ত আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক বর্তমানে অত্যন্ত ভালো। তেল প্রধান এই দেশগুলির অর্থনীতি বলতে গেলে আমেরিকার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। আমেরিকা যদি তাদের ওপর একবার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তবে তাদের সেই রমরমা যে মুহূর্তের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে সেটা ভালোই জানে এই আরব দেশগুলো। নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে প্রত্যক্ষভাবে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে চলে এই দেশগুলো।
আমেরিকা আবার তাদের চিরাচরিত অবস্থান বজায় রেখে বরাবর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে ইজরায়েলের পক্ষই নিয়েছে। উল্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে তারা আরও একধাপ এগিয়ে তেল আভিব থেকে বিতর্কিত জেরুজালেমে নিজেদের দূতাবাস স্থানান্তরিত করে। এই গোটা বিষয়টি পরিষ্কার করে দেয় আমেরিকার আনুকল্য পেতে হলে ইজরায়েলের বিরোধিতা করা চলবে না। আরব দেশগুলো আজও মতাদর্শগতভাবে ইজরায়েলের বিরোধী। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তারা আর কেউ এখন সক্রিয়ভাবে ইজরায়েলের বিরোধিতা করে না।
আমেরিকার উপস্থিতি একটি বিষয় নগ্ন করে দিয়েছে তা হল প্যান আরব ভাবাবেগ নয়, আরব দেশগুলির শাসকদের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি। তাতে তারা যাবতীয় নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।
৫) ইরানকে টাইট দেওয়া-
সুন্নি প্রধান আরব দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিবেশী শিয়া প্রধান ইরানের সম্পর্ক কখনোই মধুর নয়। এদিকে আমেরিকার সঙ্গে যখন আরব দেশগুলির ক্রমশই ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে তখন শিয়া প্রধান ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক বলা যেতে পারে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তলানীতে এসে ঠেকেছে। এদিকে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী শিয়া হেজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এই দুই গোষ্ঠী মিলে আবার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থে হামাসের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন।
ইরানকে কোণঠাসা করে দিতে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বকেও ব্যবহার করছে আরব দেশগুলো। কারণ ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত। তাই হামাস যত কোণঠাসা হয়ে পড়বে ততই রাজনৈতিকভাবেই ইরানের পরাজয় ঘটবে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তারা আরও বেশি করে প্যালেস্টাইন আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। অথচ ঘটনাচক্রে ইরানের মানুষজন আরব গোষ্ঠী ভুক্ত নয়। তবে রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এই অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।
৬) ভারতের ভূমিকা-
প্যালেস্টাইন আন্দোলনে ইহুদিবাদী ইজরায়েল এবং আরব পন্থীরা ছাড়াও আরও একটি পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তা হল ভারতের নেতৃত্বাধীন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারির দেশগুলি সর্বদাই প্যালেস্টাইনের স্বাধীন আত্মমর্যাদার বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন এবং তাদের পরিবর্তিত বিদেশ নীতির ফলে গোটা বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।
ভারত বর্তমানে মোটামুটিভাবে আমেরিকার ব্লকে অবস্থান করছে। সবচেয়ে বড়ো কথা যে ইজরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিন তারা কোনওরকম বাণিজ্যিক আদান প্রদান করেনি প্যালেস্টাইনের সমর্থনে, সেই ইজরায়েলের সঙ্গে বর্তমানে ভারতের সম্পর্ক অতি মধুর। প্রতিবছর বহু কোটি টাকার লেনদেন হয় এই দুই দেশের মধ্যে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ভারতের এই পরিবর্তিত ভূমিকা বাকি আরব দেশগুলির সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করে। তারা বুঝেছে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি।
সবমিলিয়ে এটা পরিষ্কার প্যালেস্টাইনের মানুষ আজও স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখলেও তাদের একসময়ের আপনজনরাই আজ নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তাদের পাশ থেকে সরে এসেছে। এইভাবেই নিষ্পেষিত হওয়াটাই বোধহয় প্যালেস্টাইনের আরবদের একমাত্র ভবিতব্য।