অষ্টম দফার ভোট সদ্য শেষ হয়েছে রাজ্যে। এর মধ্য দিয়ে বিসর্জনের সুর পরিপূর্ণরূপে বেজে উঠল বাংলার নির্বাচনী লড়াইয়ে। আগামী দিনে করো না পরিস্থিতির মোকাবিলায় এখন প্রধান লক্ষ্য। এরই মাঝে করোনা আবহাওয়ার মধ্যে বৃহস্পতিবার ভোট হল রাজ্যের ৩৫ টি বিধানসভা কেন্দ্রে। সারাদিনই নানান অশান্তির খবর উঠে এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। তবে প্রাণহানির মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। যদিও খাস কলকাতার বুকে যেভাবে বোমাবাজি হয়েছে তা অবাক করে দিয়েছে অনেককেই।

এর মধ্যেই বেশকিছু তারকা প্রার্থী ময়দানে দাপিয়ে বেরিয়েছেন বৃহস্পতিবার। তবে আমরা অষ্টম দফার ভোটে এমন ৮ জন তারকাকে বেছে নেব যারা ভোটের দিন ময়দানেও প্রকৃতপক্ষে দাপিয়ে বেড়ালেন।


১) কল্যাণ চৌবে-

গোলকিপার হিসেবে ভারতজোড়া নাম ছিল কল্যাণ চৌবের। তিনি মোহনবাগান ক্লাবের প্রাক্তন সচিব অঞ্জন মিত্রের জামাই। প্রতিবাদী হিসেবে অনেকদিন ধরেই তিনি পরিচিত। একবার জাতীয় শিবিরে যোগ না দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে যাবেন বলায় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের তৎকালীন সচিব কোলাসোর সঙ্গে তার মত বিরোধ হয়। তখন ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় তিনি যদি আর কোনদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলতে না চান তাহলে বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবেন। নিজের ইচ্ছের প্রতি তীব্র জেদ থেকে কল্যাণ চৌবে সেদিন লিখে দিয়েছিলেন আর কখনও জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন না। এরপর দীর্ঘদিন আই লিগে চুটিয়ে খেলেছেন এই গোলকিপার। তবু জাতীয় দলের দিকে ফিরেও তাকাননি।

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে গিয়েছিলেন কল্যাণ চৌবে। তবে রাজনীতির ময়দান ছাড়েননি। বিজেপি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তাকে মানিকতলা কেন্দ্রে প্রার্থী করে। বিপক্ষের হেভিওয়েট প্রার্থীর চোখে চোখ রেখে সকাল থেকেই ময়দানে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল সমর্থকরা কল্যাণ চৌবেকে মারধর করেছে। তবে এই ঘটনায় বিন্দুমাত্র ভয় পাননি এই তারকা প্রার্থী। যেখানেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে গন্ডগোল পাকানোর অভিযোগ উঠছে সেখানেই ছুটে গিয়েছেন কল্যাণ চৌবে। ভোটের ফল কি হবে তা পরে জানা যাবে। কিন্তু ম্যাচের দিনের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে তিনি অন্যতম সেরা।


২) সাধন পান্ডে-

মজার বিষয় সাধন পান্ডে উত্তর কলকাতার মানিকতলা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। তারই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন বিজেপির কল্যাণ চৌবে। বিজেপির যুব প্রার্থী যখন গোটা কেন্দ্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সেই সময় পিছিয়ে থাকেননি বর্ষীয়ান সাধন। মেয়ে শ্রেয়া পান্ডেকে সঙ্গী করে তিনিও কেন্দ্রের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ান। শেষ বেলার দিকে সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখা গিয়েছে এই প্রার্থীকে। তার অভিযোগ পরিকল্পিতভাবে সাংবাদিকরা কল্যাণ চৌবেকে তুলে ধরছেন।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের খুব একটা সুনজরে না থেকেও কিভাবে দিনের পর দিন এলাকায় দাপট ধরে রাখতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন সাধন। স্বাভাবিকভাবেই অষ্টম দফার নির্বাচনে তার দিকে নজর ছিল‌ই। কিন্তু সারাদিনের পারফরমেন্সেও তিনি অন্যতম সেরা তারকা হিসেবে উঠে আসলেন।


৩) অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়-

রাজ্য রাজনীতিতে এই নামটা হয়তো অনেকেরই অজানা ছিল কিন্তু অষ্টম দফার ভোটের পর সবাই এই বিজেপি প্রার্থীর নাম জেনে গিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সারাদিন বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের নাকের ডগায় দাপিয়ে বেড়ালেন তিনি। গেরুয়া শিবিরের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও দেখিয়ে দিলেন মাঠে-ময়দানের রাজনীতিটাও তিনি ভালোই পারেন।

বোলপুর কেন্দ্রের এই বিজেপি প্রার্থী বৃহস্পতিবার বারবার তৃণমূল সমর্থকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। এমনকি বিকালের দিকে তার গাড়ি ভাঙচুর করে তৃণমূল সমর্থকরা। তা সত্ত্বেও তিনি দমে যাননি। গোটা এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান। তবে কট্টরপন্থী হিন্দু হিসেবে পরিচিত অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় শেষ পাতে চোনা ফেলে দেওয়ার মতো ভোটের হিংসাকে হাতিয়ার করে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করার চেষ্টা করেছেন। তার রাজনৈতিক পথ চলা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে তবে অষ্টম দফার ভোটে যে তিনি অন্যতম সেরা তারকা সেটা বলাই যায়।


৪) মনোজ চক্রবর্তী-

বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী মনোজ চক্রবর্তী রাজ্য রাজনীতির পরিচিত মুখ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই কেন্দ্রে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতে আসছেন। অষ্টম দফার ভোটে মনোজবাবুর মূল প্রতিপক্ষকে কে সেটা নিয়েই লড়াই চলেছে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে। বৃহস্পতিবার এই কেন্দ্রে একসময় বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে। পরে পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গিয়ে এলাকায় হাজির হতে হয়।

মনোজ চক্রবর্তীকে সারাদিন এলাকায় দেখা গিয়েছে কিন্তু শত অভিযোগের মধ্যে একবারও বিচলিত হয়ে পড়েননি। দাপটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন। তিনি সবচেয়ে বড় কথা তার মাথার ওপর ‘দাদা’ অধীর চৌধুরীর হাত আছে। তাই বৃহস্পতিবারের ভোটে মনোজ চক্রবর্তীও অন্যতম তারকা হিসেবে জায়গা পোক্ত করলেন।


৫) শশী পাঁজা-

উত্তর কলকাতার আরেক বিধানসভা কেন্দ্র শ্যামপুকুরের তৃণমূল প্রার্থী শশী পাঁজা। শিক্ষিত এবং ভদ্র রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত শশী পাঁজার শ্যামপুকুর কেন্দ্র বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এখানে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল এবং বিজেপি সমর্থকরা। যদিও এই তৃণমূল প্রার্থী সারাদিন ভোটের ময়দানে ছিলেন। পেশায় চিকিৎসক শশী পাঁজা এই করোনা পরিস্থিতিতেও ঠান্ডা মাথায় দাপটের সঙ্গে নিজের কেন্দ্রে ভোট পরিচালনা করেছেন। দলের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতের যে আশঙ্কা আছে তাও ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তিনি নিজের পক্ষে ভোট করাতে পেরেছেন বলেই অনুমান। রাজ্যের এই তারকা রাজনীতিবিদ অষ্টম দফার ভোটে নিজেও তারকা হিসেবে উঠে আসলেন।


৬) শ্যামলী প্রধান-

নানুরে এবার এক অসম লড়াইয়ে নেমেছে সিপিআই(এম)। এই কেন্দ্রে তারা প্রার্থী করেছে বিধায়ী বিধায়ক শ্যামলী প্রধানকে। এই মহিলা নেত্রী রাজনীতিতে ততটা পরিচিত নাম না হলেও নিজের এলাকায় লড়াকু হিসেবেই পরিচিত। এবারের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল এবং বিজেপির দাপটের মাঝেও তিনি তার নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এবারের ভোট প্রচারে একাধিকবার তাকে হুমকি দিয়েছেন তৃনমূলের স্থানীয় নেতারা। বিজেপির হুমকি থেকেও বাদ যাননি তিনি। কিন্তু ভোটের দিন দেখা গেল তৃণমূল এবং বিজেপির পাশাপাশি নানুরের ভোট ময়দানে সমানতালে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শ্যামলী প্রধান।

এ রাজ্যে নানুর বরাবরই উত্তেজনা প্রবণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এবারেও ভোটের দিন এই কেন্দ্র থেকে একাধিক বোমা উদ্ধার করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সকাল থেকেই দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এখানে। যদিও যাবতীয় বিতর্ককে ছাপিয়ে গিয়ে ময়দানে উপস্থিত থেকে ভোট করিয়ে গিয়েছেন শ্যামলী প্রধান। এই তথাকথিত অপরিচিত মুখ অষ্টম দফার নির্বাচনের দিন অন্যতম তারকা প্রার্থী হিসেবে উঠে এলো।


৭) পরেশ পাল-

তৃণমূলের অভ্যন্তরে পরেশ পালের অবস্থাটা বড়োই অদ্ভুত। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে খুব একটা পছন্দ করে না, আবার তাকে ফেলেও দিতে পারেন না। সেই কারণেই তরুণ জীবন সাহাকে বাদ দিয়ে পরেশ পালকে আবারও বেলেঘাটা কেন্দ্রে প্রার্থী করে দল। বৃহস্পতিবার ভোটের দিন সেই বর্ষীয়ান পরেশ পালকেই দেখা গেল গোটা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতে। একাধিকবার তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে ভোট লুটের অভিযোগ উঠেছে। তবুও পরেশ পাল নিজের স্ট্র্যাটেজি বদলাননি। সারাদিন তিনি দাপিয়ে বেড়ালেন বেলেঘাটা কেন্দ্র জুড়ে। অষ্টম দফার ভোটে তিনিও অন্যতম তারকা।


৮) নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়-

প্রাক্তন অভিনেত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য রাজনীতির অন্যতম তারকা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করার পর রাজনীতির ময়দানে নামেন। মধ্য কলকাতার চৌরঙ্গী কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তিনি। নয়নাদেবী এমনিতেই রাজ্যের অন্যতম তারকা প্রার্থী। তবে অষ্টম দফার ভোটে তিনি তার কেন্দ্রে যেভাবে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ভোট পর্ব পরিচালনা করলেন তা সত্যিই রাজনৈতিক মহলের নজর কেড়ে নিয়েছে। প্রমান হয়ে গিয়েছে তিনি একসময় অভিনেত্রী থাকলেও বর্তমানে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন। সবদিক থেকেই অষ্টম দফার ভোটে নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্যই একজন তারকা প্রার্থী।