অবসাদ কাটিয়ে ফিরে পেতে চান আত্মবিশ্বাস? এই ১০টি সহজ উপায় রয়েছে হাতের কাছেই। জেনে নিন।
অবসাদ একবিংশ শতাব্দীর একটি প্রকট সাধারণ অসুখ, যা ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের কোণায় কোণায়।মহামারির মতো তাৎক্ষনিক মারনব্যাধি নাহলেও দীর্ঘকালীন ফেলে রাখা অবসাদ প্রতিবছরই কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ।সমীক্ষায় দেখা যায় গোটা বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখেরও বেশি মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন, যা অন্যান্য রোগে মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব, এই অসুখ ফেলে রাখবেন না। আজই সতর্ক হন এবং অবসাদমুক্ত আত্মবিশ্বাসী মন ফিরে পান।
যন্ত্র সভ্যতার অগ্রগতি যেমন বদলে দিয়েছে আমাদের স্বাভাবিক জীবন, তেমনি বদলে দিয়েছে মানবিকতার সংজ্ঞাও। আমরা পরস্পরের প্রতি উদার মনোভাব রাখতে পারিনা আর; কারণ, সবাই নিজেদের একেকজন প্রতিযোগী ভাবি। আমরা যারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারিনা বা অন্যজনের থেকে সাময়িক পিছিয়ে পড়াটুকু মেনে নিতে পারিনা তারাই অবসাদের শিকার হই। এবছর পরিস্থিতি আরও আলাদা। অনেকদিন বাড়িতে আটক সকলেই। করোনা পরিস্থিতিতে অনেককিছুই থমকে গেছে এবছর। দেশ জুড়ে চরম অর্থনৈতিক সংকট এবং বেকারত্ব।এই পরিস্থিতিতেও কীভাবে বজায় রাখবেন মনোবল? হতাশ হবেন না। জেনে নিন অবসাদ কাটানোর এই মোক্ষম দশ উপায়।
১। কারও কাছে অধিক প্রত্যাশা করবেন না
কখনই প্রত্যাশা করবেন না দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তি আপনাকে বুঝে চলবে বা আপনার মনের মতো হবে। নিজের সমস্ত কাজ নিজেই করতে শিখুন । জীবনের কোন ক্ষেত্রেই কারও ওপর নির্ভর করে থাকবেন না। কেউ আপনাকে কোনকিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মানেই যে সে কথা রাখতে সমর্থ হবে এমনটা ভেবে থাকবেন না। এতে নিজেরই যন্ত্রণা বাড়ে। সবকিছুকে হালকা করে না দেখলে এই যুগে তাল মেলাতে পারবেন না।
২। সবসময় কাজের মধ্যে থাকুন
অলস মস্তিষ্কই অবসাদের চারণভূমি। খেয়াল করুন, যতক্ষণ কাজের দায়িত্বে থাকেন অবসাদ আপনাকে স্পর্শ করেনা। সবসময়য়েই কিছু না কিছু কাজ করতে থাকুন ,যতক্ষণ না ক্লান্তি বোধ করছেন। অফিসের কাজ না থাকলে বাড়িতে থেকেও নানা ধরনের কাজের পরিকল্পনা করতে পারেন। ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে দিন। কোন সমাজসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। যদি উপার্জনের চিন্তা না থাকে তবে ঘর সাজান, বাগান করুন। রান্না করুন নিত্য নতুন পদ। আপনার পছন্দের যেকোনো কাজ বেছে নিন আর সবসময় কাজের মধ্যেই থাকুন।
৩। নিয়মিত শরীর চর্চা করুন
অবসাদ কাটাতে প্রতিদিন শরীরচর্চা করুন। জিমে ভর্তি হন কিংবা বাড়িতেই প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় ১৫-৩০ মিনিট সময় রাখুন যোগা, ফ্রিহ্য্যান্ড বা প্রাণায়ামের জন্য। এরফলে মস্তিস্ক সমেত সারা শরীরেই ঠিকমত রক্ত সঞ্চালন হবে । এছাড়াও হ্যাপি হরমোন বা এনডরফিন নিঃসৃত হলে আপনার মন অনেক ভাললাগবে। শরীরচর্চা করার সময় পছন্দমত ছন্দের ভাল ভাল গান প্লে-লিস্ট এ চালিয়ে রাখতে পারেন। এছাড়াও প্রতিদিন ভোরবেলা প্রাতঃভ্রমন করুন একঘণ্টা।
৪। ভালো করে ঘুমোন
আপনি যদি ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতার সমস্যায় ভোগেন তবে সবার আগে সেটির চিকিৎসা করান। ঠিকমত না ঘুমোলে শরীরে বাসা বাঁধে নানান রকম জটিল ব্যাধি। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা না ঘুমোলে শরীরের কোষগুলি বিশ্রাম পায়না । তাই পুষ্টি পাবেনা আপনার মস্তিষ্কও, যার থেকে অবধারিতভাবে আসে অবসাদ। অনেকসময় মানসিক চাপের কারণেই টানা ঘুম হয়না ভাল সেক্ষেত্রে ঘুমনোর আগে দশমিনিট মনঃসংযোগ করে ধ্যান বা প্রাণায়াম করুন অল্প আলোয়।
৫। নেতিবাচক চিন্তা নয়
নিজেকে মূল্যহীন বা ফেলনা ভাববেন না। আপনিও অনেক কিছু পারেন যা অন্যেরা পারেনা। নিজের ভাল গুণগুলো সামনে আনার চেষ্টা করুন। কেউ বাহবা না দিলেও যেগুলো করতে ভালবাসেন সেগুলো রোজ করুন। নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না, কোন নেতিবাচক চিন্তাই প্রশ্রয় দেবেন না। খারাপ কোনোকিছু ঘটলে তার জন্য নিজেকে দায়ী করা বন্ধ করুন। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবেন না জীবন, মনে রাখবেন মানুষ নিজের ভাগ্য নিজের কাজ ও অবদান দিয়েই তৈরি করে।
৬। বিপরীতবাদীদের সংসর্গ থেকে দূরে থাকুন
চারপাশে এমন অনেক মানুষ থাকে যারা প্রতিনিয়ত অন্যের সমালোচনা করে। আপনার বন্ধুতালিকায় যদি এমন কোন ব্যাক্তি থাকে তাঁকে পরিহার করুন। যারা অন্য কাউকে ছোট করে আনন্দ পায়, জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের থেকে দূরে থাকুন। পাড়া-পরশী কেউ যদি আপনাকে মনোবল না জুগিয়ে উলটে আত্মসম্মানে আঘাত দিয়ে কথা বলতে আসে তাঁকে প্রশ্রয় দেবেন না আর। মতের অমিল আছে যাঁদের সঙ্গে, তাঁদেরও কিছুদিন এড়িয়ে চলুন। অবসাদ কাটিয়ে, যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস অর্জন করে তবেই আবার বিতর্কে যোগ দিন।
৭। পশুপাখিদের সাহচর্যে থাকুন
পশুপাখি ভালবাসেন? তাহলে তারাই আপনার অবসাদ কাটিয়ে দিতে পারে। সুযোগ পেলে পশুপাখিদের সঙ্গে সময় কাটান। আপনারই কোন পরিচিতের বাড়ির পোষা প্রাণীর সঙ্গে ভাব জমানো দিয়ে শুরু করুন। দুস্থ পশুপাখির সংখ্যাও চারপাশে কম নয়। উপযুক্ত জায়গা থাকলে ওদের কাউকে বাড়িতে এনে রাখতে পারেন। পুষতে পারেন নানা জাতের কুকুর ,বেড়াল ; যারা মানুষের সঙ্গ চায়। অকারণে পাখিদের বন্দি করবেন না। পাখিরা নিজে থেকেই খেতে আসে অনেকসময়। পায়রা, শালিখ বারান্দায় এসে বসলে তাঁদের ডেকে যত্ন করে খাওয়াতে পারেন রোজ। নিজের ঘরে রাখতে পারেন অ্যাকুয়ারিয়াম। মাছেদের খেলা দেখলেও মন ভাল থাকবে আপনার।
৮। সোশ্যাল মিডিয়ায় কম সময় কাটান
সারাদিন ফেসবুকে বন্ধুবান্ধবের পোস্ট দেখছেন? মন ভাল থাকবেনা আপনার। বেশিরভাগ মানুষ নিজের প্রতিভা জাহির করতেই ব্যবহার করেন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। সেইসব পোস্ট দেখলে নিজেকে ব্যর্থ এবং মূল্যহীন মনে হতে পারে। তাই দিনের শুরুতেই ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম চেক করবেন না। আগে দিন শুরু করুন, নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিন তারপর একান্তই ইচ্ছে করলে খুব অল্পসময়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকুন। সময় নষ্ট করবেন না অন্যদের জীবন দেখে। ভাল কিছু অনুষ্ঠান শুনুন। তথ্য জানতে পারেন এমন পেজ ফলো করুন। চেষ্টা করুন সারাদিনে একঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই এখানে না দিতে।
৯। ঘর সাজান ও গুছিয়ে রাখুন
যে ঘরটায় আপনি থাকেন সেখানে এতটুকুও ধুলো জমতে দেবেন না। নিজে ফিটফাট থাকুন এবং সবসময় ঘর গুছিয়ে রাখুন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিছানাটা আগে ঠিকঠাক করে ফেলুন। আসবাব ঝেড়ে নিন। ধুলো ময়লার মধ্যে দিন কাটালে গুরুতর অবসাদ আসতে পারে। আপনার মনঃসংযোগেরও অভাব হতে পারে। সপ্তাহে ফাঁকা সময় বের করে ঘর সাজান। নতুন নতুন সজ্জার উপকরণ কিনে পছন্দের থিমে গোটা বাড়ি সাজিয়ে ফেলুন। ঘরে রাখতে পারেন সবুজের ছোঁয়া। সজ্জার উপকরণ না পেলে কেবলমাত্র ইনডোর প্ল্যান্টস দিয়েই ঘর সাজিয়ে ফেলতে পারেন মনের মতো।
১০। অবসরেও অলস সময় কাটাবেন না
কাজের পর বিশ্রাম নেবার সময় কিংবা সারাদিনে কখনই শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাবেন না। বিশ্রামের সময়েও আমাদের মাথার ভেতরে চলতে থাকে অজস্র চিন্তার জট। এতে মনের পুষ্টি ব্যহত হয়। অবসর থাকলে একটা ভাল বই পড়ুন। প্রেষণা এবং অনুপ্রেরনা সঞ্চার করে এমন চলচ্চিত্র দেখুন। সুন্দর একটি ছবি আঁকুন অথবা নাচ শিখুন। শিখতে পারেন ক্যারাটেও। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে চোখ বুজে শাস্ত্রীয় সংগীত এবং ভাল বাজনা শুনুন। কিংবা শুনুন পছন্দ মত দেশি বিদেশি গান, কিন্তু কোনোভাবেই দুঃখের গান শুনবেন না। অবসাদ কাটাতে সংগীতের গুরত্ব নিশ্চয়ই জানেন, নিজেই চেষ্টা করে দেখুন না। ভালোলাগার সমস্ত উপকরণ রয়েছে আপনার হাতের সামনেই।
উপরের সবকটি সতর্কতা যদি মেনে চলেন আপনার অবসাদ নিশ্চয়ই দ্রুত কাটবে। যদি একান্তই না পারেন, একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, শুধুমাত্র আনন্দে থাকার ইচ্ছে এবং অদম্য আত্মবিশ্বাসই আপনাকে অবসাদের কবলে পড়তে দেয়না। পরিস্থিতি যেমনই হোক, ঠাণ্ডা মাথায় সেটা সমাধান করুন। অন্যের চোখে নয়, নিজের কাছে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করুন। নিজেকে সম্মান করতে পারার মতো কাজ করে চলুন একের পর এক। এগুলো মেনে চললে অবসাদ আপনাকে ভবিষ্যতেও আর স্পর্শ করবেনা।
[…] […]
[…] […]