গতকাল (১৯ ডিসেম্বর, ২০২০) তৃণমূল থেকে শুভেন্দু অধিকারীর পাশাপাশি তাদের এক ঝাঁক বিধায়ক এবং জেলা স্তরের নেতাকর্মীরা বিজেপিতে যোগদান করে। এমনকি বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের সংসদ সুনীল মণ্ডলও অমিত শাহের হাত থেকে পতাকা নিয়ে গেরুয়া শিবিরের নাম লেখায়। এরই মাঝে জল্পনা তীব্র হয়ে ওঠে হুগলি জেলার তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদবের দাদাকে কেন্দ্র করে।
জানা যায় বৃহস্পতিবার রাত্রি ১০:৩০ এর পর দিলীপ যাদবের দাদা আচ্ছা লাল যাদবের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন ব্যারাকপুরে তৃণমূল সাংসদ অর্জুন সিং এবং শঙ্কুদেব পণ্ডা। জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে দলত্যাগীদের তালিকায় নাম লেখাতে চলেছেন শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ব্লকের কানাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আচ্ছা লাল। সেইসঙ্গে জল্পনা তীব্র হয় তাহলে কি হুগলি জেলার সভাপতি দিলীপ যাদবও এবার গেরুয়া শিবিরের পথে পা বাড়ালেন?
এই খবর চারিদিকে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে শুক্রবার বেলার দিকে আচ্ছা লাল যাদব দাবি করেন হঠাৎই তার বাড়ি অর্জুন সিং এবং শঙ্কুদেব পণ্ডা চলে আসেন। তিনি এই বিষয়ে নাকি আগে থেকে কিছুই জানতেন না। কিছু না জানিয়ে অর্জুন সিং তার বাড়ি চলে আসায় সৌজন্যে রক্ষার খাতিরে তিনি তাদের বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসান এবং কফি খেতে দেন। সেইসঙ্গে দাবি করেন তাকে ঘিরে দলত্যাগের যে জল্পনা ছড়িয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। এই তৃণমূল নেতা বলেন, “দল আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে। এর আগে আমি শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলাম। এখন কানাইপুর পঞ্চায়েতের প্রধান। আমি তৃণমূল ছাড়ছিনা।”
আচ্ছা লাল যাদব এই দাবি করলেও হুগলির রাজনৈতিক মহলের সবাই জানে তার এবং দিলীপ যাদবের সঙ্গে উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক প্রবীর ঘোষালের “সুসম্পর্কের” কথা। দিলীপ যাদবকে জেলার সভাপতি করার পর একাধিকবার প্রবীর ঘোষাল শিবিরের সঙ্গে তার বিবাদের কথা সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে। যদিও মাসখানেক আগে তৃণমূল সুপ্রিমো দলের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করার পর দিলীপ যাদবকেই হুগলির জেলা সভাপতি দেখে দিয়ে প্রবীর ঘোষালকে সেই জেলার প্রধান মুখপাত্রের দায়িত্ব দেন।
এরপরই শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব নিয়ে এই দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা দ্বন্দ্ব মেটানোর উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগে প্রবীর ঘোষাল এবং দিলীপ যাদবের মধ্যে মিটমাট হলেও আচ্ছা লাল যাদব তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিতে রাজি হননি। শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া অঞ্চলে কান পাতলেই শোনা যায় হিন্দিভাষী প্রভাবিত উত্তরপাড়ার বিধায়ক হওয়ার স্বপ্ন মনে মনে বয়ে নিয়ে বেড়ান এই তৃণমূল নেতা।
উত্তরপাড়ার রাজনীতিতে প্রবীর ঘোষালের পরিবারের দাপট দীর্ঘদিনের। তার বাবা এখানকার কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। তাই তাকে সড়িয়ে বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপাড়ার টিকিট পাওয়া যে তার পক্ষে সম্ভব নয় তা বোধ হয় বুঝে গিয়েছিলেন আচ্ছা লাল। সেইমতো তার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করে দেন তিনি। আর এর প্রমাণস্বরূপ আমাদের হাতে এসে উপস্থিত হয়েছে “কানাইপুর অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেস” নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কিছু স্ক্রীনশট।
যাতে দেখা যাচ্ছে গত ১০ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের যারা সদস্য ছিলেন তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে বা রিমুভ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এডমিন আচ্ছা লাল যাদব নিজে এবং দিলীপ যাদবও ওই গ্রুপের সদস্য ছিলেন।
এই ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে কী উদ্দেশ্যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সমস্ত সদস্যকে বার করে দিলেন কানাইপুর পঞ্চায়েতের প্রধান ? তাহলে কি তিনি ধীরে ধীরে তৃণমূলের থেকে দূরত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্যেই এই কাজ করলেন ? প্রশ্ন জাগছে মুখে অস্বীকার করলেও তিনি কি পরিকল্পিত ভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছেন ? তাই কি সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে আলোচনা করার জন্য রাত্রি সাড়ে দশটার সময় তার বাড়িতে আসেন অর্জুন সিং ?
প্রশ্ন এখানেই শেষ নয়। সংশয় তৈরি হয়েছে তবে কি অর্জুন সিংয়ের তার বাড়ি আসার ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতেই মুখ রক্ষার স্বার্থে দলত্যাগের সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করলেন এই তৃণমূল নেতা ? আরো এক প্রশ্ন হুগলির রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা হল দাদা আচ্ছা লালের মাধ্যমে বিজেপি শিবিরের সঙ্গে কি দর কষাকষি চালাচ্ছেন জেলা সভাপতি দিলীপ যাদব ?
আমরা কোনো বিষয়েই নিশ্চিত নই। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের ওই প্রমাণ হাতে আসার পর কতগুলি নতুন প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে, যা হুগলির ভোটারদের সামনে তুলে ধরা সংবাদমাধ্যমের কর্মী হিসাবে আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি। এখন অপেক্ষা গোটা ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় তার জন্য।
[…] […]