‘সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ/ সবচেয়ে সেরা সে যে গাছ”- আমাদের প্রিয় ম্যানগ্রোভের অনেক কিছুই যে সেরা তা আমরা জানি। সুন্দরবন বাঘ, মধু, মাছ, নদী, অরণ্য প্রভৃতি সবরকম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা। আরও আছে শ্রেষ্ঠ রঙিন এক সম্পদ। ঠিক ধরেছেন, পাখিরা। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সুগন্ধি, শুষ্ক এক টাটকা বাতাস শীতের আগমন বার্তা নিয়ে ভেসে আসে। প্রকৃতির ঘরে ঘরে সে ডাক দিয়ে বলে, উৎসবের আগাম তোড়জোড় শুরু হোক!কিসের উৎসব? এই উৎসব আগামীর। শীত মানেই ঋতুচক্রের শেষ। বসন্ত পেরলেই আবার নতুন বছর। নতুন বছর মানে নতুন সাজ, নতুন সৃষ্টির আনন্দ। আয়োজন কি কম! রোদে জ্বলা ক্রান্তীয় বনাঞ্চল আবার তার ঘন সবুজ কেশরাশি আকাশে মেলে দুলতে থাকে।প্রকৃতি জুড়ে তখন সাজো সাজো রব! অরণ্যের হিরে-মানিক, মুক্তা খচিত অলংকার স্বরূপ পরিযায়ী পাখিদের দল দূর দূরান্ত থেকে এসে পড়লো বলে!সবুজের সর্বাঙ্গে আহ্বান জানিয়ে অরণ্যে তাদের স্থান সংকুলান করতে হবে যে। তারপর শীতের সংসার জমে উঠবে অন্তহীন কিচিরমিচিরে।
এবছর প্রকৃতি কি কিছুটা আনমনা?
নভেম্বর শেষ হয়ে যেতেও ভারত বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভে দীর্ঘ সময় পরিযায়ীর দেখা মেলে নি।বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ জুড়ে সবুজ চাদরের মতো অখণ্ড ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তার। অরণ্যে সুন্দরী গাছের আধিক্যের জন্যই তার আদরের ডাকনাম- সুন্দরবন। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ দুই বাংলার অর্থনীতিকে সুদূর প্রাচীনকাল থেকে তুলে ধরে রেখেছে।কিন্তু বর্তমানে পৃথিবী ব্যাপী অর্থনীতির মন্দা। করোনার সময় কাজ হারিয়েছেন লক্ষ্যাধিক মানুষ। এবছর চাষবাস সেভাবে হয়নি পশ্চিমবঙ্গে; ফলন অল্প। তাই বছর শেষেও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের আগুন দাম, গোটা বছরের গড়মিলই চোখে পড়তে বাধ্য।
প্রকৃতির খেয়াল নয়। মানুষের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতার পাকে পড়েই বাস্তুতন্ত্রের চেহারা আজ বিধ্বস্ত।করোনার সংক্রমণ এড়াতে বহুদিন জেলায় জেলায় যোগাযোগ বন্ধ থাকায় অরণ্যের খবর সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছয় নি। সাগর পাড়ের ২৪০০ বিঘে জমির ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে ফেলে সেখানে গলদা ও কুচো চিংড়ির চাষ করেছে মুষ্টিমেয় অর্থপিশাচ। ফলতঃ পরিযায়ী পাখিরা এসে ঝাঁকে ঝাঁকে যে গাছগুলির উপর বসত, সেসব গাছ আর নেই। তারা এসে ফিরে গেছে আবার। সবকিছুই অসহায়ভাবে খেয়াল করেছেন স্থানীয় মানুষ।কিন্তু তাঁরা খবর দিতে পারেন নি কাউকে শেষ কমাসে। অরণ্য ছেদন হয়েছে নির্বিচারে।এবছর তাই প্রকৃতির সাজে পড়লো ভাঁটা।
সুন্দরবনের পাখিরা
দুই বাংলার পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৬৫০ টি। এর মধ্যে ৩০টি বর্তমানে বিলুপ্ত। সুন্দরবনের অরণ্যপ্রকৃতি কাঁটাতারের ব্যবধান জানেনা। তাই পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের কথা এখানে একসঙ্গেই বলা চলে। নিয়মিত ৪৭৭ রকম প্রজাতি সুন্দরবনে দেখা যায় যার ৩০৭টি বাংলার নিজস্ব এবং ১৭৬টি প্রজাতি পরিযায়ী। সুন্দরবনের পাখিদের মধ্যে মদন টেক, মাছরাঙা, কানাকুয়ো, তিলানাগ, ইগল, শিকরে, টুনটুনি, চিল, বক, সারস প্রভৃতির নাম করা যায় যাদের প্রায় সবসময় দেখতে পাবেন। এরা বেশিরভাগই মৎস্যভোজী পাখি, কারণ সুন্দরবনে কোন শস্যক্ষেত বা খাওয়ার উপযোগী ফলগাছ নেই। কেবল মাছ আর মাছ। সুন্দরবনে এখন আমরা যেসব পাখি দেখি তার মধ্যে পঁচিশ শতাংশই মৌসুমি পাখি। পাখি সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য সুন্দরবনে দুটি অভয়ারণ্য আছে- চুনকুড়ি খাল পাখি অভয়ারণ্য এবং জিউধারা। চুনকুড়ি অভয়ারণ্যটি বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পর এই অরণ্যে অতিরিক্ত বৃক্ষছেদনের ফলে পাখির বাসা নষ্ট হয়। অনেক ডিম এবং পক্ষীশাবক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর সেখানে পরিযায়ীদের ভিড় অনেকটাই কমে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জের কালিতলা পঞ্চায়েতের পাখিরালয় গ্রাম থেকে শুরু করে ঝিঙেখালি অবধি এবং অপর পাড়ে কৈখালী, কুঁড়েখালি, কালমঞ্চি জঙ্গল বাংলাদেশের পাখিদের আস্তানা। শীতের মরসুমে দেশি-বিদেশি পরিযায়ী পাখিরা এখানেই এসে ভিড় করে, আর তাদের দেখতে প্রচুর পর্যটক চলে আসেন সুন্দরবনে। পাখিরা দিন ভর মনের আনন্দে খেলে বেড়ায়। মাছ ধরে আর খায়। মাছধরার এমন ধুম পড়ে যায় যে মানুষ কাছে গিয়ে ছবি তুললেও এসময় তাদের ভ্রূক্ষেপ থাকেনা। আর তার সঙ্গে চলে উচ্ছ্বসিত কলতানের কোলাহল। বিকেল গড়াতেই আবার তারা ফিরে যায় অরণ্যে। তাদের সুমিষ্ট ভাব-ভঙ্গি, অভিনব সংসার জীবন ফ্রেমবন্দী করতে পাখিপ্রেমীরা ক্যামেরা হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন।
প্রকৃতির খেয়াল এরকমই, আছে সুখবর।
দেরিতে হলেও এবছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ঢল নেমেছে পরিযায়ী পাখিদের। অবশেষে আস্তানা খুঁজে পেয়ে তারা অরণ্যের শোভা বৃদ্ধি করছে বর্তমানে। হিঙ্গলগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা কিছু বেশিই! কারণ, মানুষ এতদিন ঘরে বসে থাকায় এবছর বায়ুদূষণের মাত্রা খুব কম। তাতে প্রকৃতি আপাতত প্রসন্ন। উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়েছে অতএব। মানুষের পদক্ষেপ পেলেই যদিও তারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েতাই চড়ুইভাতি করতে এলে সুন্দরবন কর্তৃপক্ষের কড়া সতর্কতা থাকে যেন জোরে মাইক বাজানো না হয় জঙ্গলের ভেতরে। কাছাকাছির গেস্ট হাউসগুলোতেও আসতে কথা বলেন পর্যটকরা। অরণ্য অঞ্চলে তাই শীতের মরসুমে অবাঞ্ছিত শব্দের উপদ্রব নেই। গাছের মাথা দোলানর শব্দের ফাঁকে ফাঁকে দমকা বাতাসে ভেসেআসে পরিযায়ীদের অনবরত কলতান। এতদিনের পৃথিবী ঘোরার সমস্ত গল্প জমে আছে, সেইসব উজার করতেই তো দুদণ্ড বসতে আসা!।
ওদের বাসস্থান, ওদের গল্পগুলো কেড়ে নেবেন না প্লিজ