ওয়াল্ট ডিসনি

‘ডিসনি’ বলতেই কি মনে আসে?


একজন বিখ্যাত আমেরিকান কার্টুনিস্ট, না সর্বকালের একটি বিপুল জনপ্রিয় স্টুডিও? শিশুদের একটি পছন্দের ব্র্যান্ড , নাকি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের জন্মস্থান? নাকি ‘ডিসনি’ বলতেই মনে আসে স্বপ্নের মত এক বিরাট বিনোদন পার্ক ? অথবা সবকটিই?
না, ঠিক পুরোটা ভাবতে পারছেন না। আসলে ওয়াল্ট ডিসনি হল অনন্ত কল্পনাপ্রবণ এক ইচ্ছের সংক্ষিপ্ত নাম। সেই ইচ্ছে ছিল এতই জোরালো যে তা বাস্তবায়িত না হয়ে পারেনি। বহুযুগ আগের সেই কল্পনার বীজ আজ কেবল মহীরুহই হয়নি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমস্ত বয়েসি মানুষের আবেগ, স্মৃতি ও রোমাঞ্চের অংশ হয়ে , বিপুল এক ঐতিহাসিক ছত্রের মতো বিরাজ করছে। কে সেই ব্যাক্তি, যাঁর ইচ্ছের ছোঁওয়ায় রঙিন হয়ে গেছিল গোটা দুনিয়া? নাম তাঁর ওয়াল্টার ইলিয়াস ডিসনি, ওরফে ‘ ওয়াল্ট’। তাঁর আজ একশো আঠেরোতম জন্মদিন।

সামনে ছিলনা কোন উদাহরণ। মিকি -ডোনাল্ড-গুফিরা আসার আগে ‘ছোটদের বিষয়’ বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব সেরকমভাবে তখনও ছিলনা। বড়দের কঠিন বাস্তবে, শিশুমনের এক বিপুল কারখানার ছবি বুকে নিয়ে বড় হলেন ওয়াল্ট, শুধু তাই নয়! সেটিকে হুবহু বাস্তবায়িত করলেন। আর সেই প্রথম রচিত হল শিশুজগৎ। বিশ্বের প্রতিটি শিশুমনের আজও একমাত্র ঠিকানা – ওয়াল্টস ডিসনি ওয়ার্ল্ড । কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এতকিছু? সেই গল্পই আরেকবার শোনা যাক।

কেমন ছিল ওয়াল্টের প্রথম জীবন?

ওয়াল্ট ডিসনিঃ একটি স্বপ্নের কারখানা
ডিসনি বলতেই কি মনে আসে
source: business and leadership


১৯০১ সালে শিকাগোর একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন ওয়াল্ট। বাবা ছিলেন পেশায় ছুতোর, চাষি এবং ঠিকাদার। মা স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওয়াল্টার ছিলেন তাঁদের চতুর্থ সন্তান, পাঁচ ভাইবোনের একজন। তিনি যখন খুব ছোট, সপরিবারে মিসৌরির এক গ্রামে গিয়ে তাঁরা বসবাস শুরু করেন। সেখানে হাঁস মুরগি, কুকর , বিড়াল, ইঁদুরকে সারাক্ষণ কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান ওয়াল্ট। ঝোপের মধ্যে একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পশুদের দৌড়াদৌড়ি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করতে থাকেন।
সাত বছর বয়েস থেকে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। মূলত আঁকতেন বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের ছবি। কিছুদিনের মধ্যেই পাড়া-পড়শির কাছে ওয়াল্টের আঁকা ছবিগুলির বেশ চাহিদা তৈরি হয়। আঁকা ছবিগুলি তিনি বিক্রি করতে শুরু করেন; যদিও টাকার বিনিময়ে নয়। বদলে নিতেন ক্রেয়ন রং অথবা চকলেট। এই সময়ে তিনি স্কুলে ও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু অস্থিরমতি বাবা ইলিয়াস শীঘ্রই কৃষিকাজে ইস্তফা দিয়ে ১৯১১ সালে পরিবারকে নিয়ে কানসাস শহরে চলে গেলেন।

সেখানে সকালের খবরকাগজের ব্যবসা শুরু করে চার ছেলেকে কাগজ বিলির কাজে লাগিয়ে দেন।
ওয়াল্ট একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তার পরবর্তী জীবনের অনেক অভ্যাস এবং আদর্শ তৈরি হয়েছিল নিয়মিত কাগজ বিলির এই অস্বস্তিকর কাজটিতে এসেই। বাবাকে সাহায্য করতে গিয়েই তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন এইসময়ে।
ট্রেনের প্রতি এক গভীর আগ্রহ অনুভব করেছিলেন তরুণ ওয়াল্ট । কাকা মারটিন যে রুটে ট্রেন চালাতেন সেই রুটেই একটি গ্রীষ্মকালীন কাজ নিয়েছিলেন, যাত্রীদের খবরের কাগজ এবং টুকটাক খাবার বিক্রি করা ।
১৯১৭ সালে তিনি শিকাগোতে ফিরে ম্যাকিনলে হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ছবি আঁকা, কার্টুন তৈরি এবং ফটোগ্রাফি শিখতে শুরু করলেন। তিনি ক্রমশ আশাবাদী হচ্ছিলেন যে সংবাদপত্রে কার্টুনিস্ট হিসেবে শীঘ্রই কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। স্কুলছুট হয়ে সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখাতে গেলেন ওয়াল্ট, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বাতিল হলেন। পরিবর্তে যোগ দিলেন আমেরিকান রেড ক্রসে। একবছর ফ্রান্সে গিয়ে এ্যাম্বুলেন্স চালালেন এবং ১৯১৯ সালে আবার শিকাগোতে ফিরে আসেন।


ওয়াল্ট ডিসনির প্রথম কার্টুন

ওয়াল্ট ডিসনি
source: VisitKC

১৯১৯ সালে কানসাসে ফিরে একটি সংবাদপত্রে চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ভাইয়ের দেওয়া একটি চাকরির সুত্রে পেসমেন-রুবিন আর্ট স্টুডিওতে দেখা হয় কার্টুনিস্ট উব আইওয়ার্কসের সঙ্গে। সেখান থেকেই শুরু ডিসনির স্বপ্নের কারখানার পথ চলা। আইওয়ার্কসের কথা অনুযায়ী ওয়াল্ট যোগ দিলেন একটি বাণিজ্যিক আর্ট স্টুডিওতে । সেখানে বিজ্ঞাপনের জন্য ছোট ছোট অ্যানিমেশন ভিডিও বানাতে শুরু করলেন। ক্যামেরা নিয়ে হাতে আঁকা এককের উপর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে কিছুদিন পর তিনি মনস্থির করলেন নিজস্ব একটা অ্যানিমেশনের ব্যবসা খুলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ; সেই বিজ্ঞাপন সংস্থা থেকেই ফ্রেড হারমান এসে চাকরি নিলেন ডিসনির অফিসে।

তাঁরা দুজনে মিলে কার্টুন বানাতে শুরু করলেন যেগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘লাফ-ও-গ্রামস’। একটি স্থানীয় সিনেমা হলে সেগুলো দেখানো হতে লাফ-ও-গ্রামস নিমেশে জনপ্রিয় হয়ে যায়। অর্থ সংস্থান হলে ওয়াল্ট একটি স্টুডিও খুললেন ওই নামেই।
ততদিনে স্টুডিওর কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়। ১৯২৩ সালে লাফ-ও-গ্রামস স্টুডিও বানিয়ে ফেলল সাত মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি রুপকথা অ্যানিমেশন সিরিজ “অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড ’’। কিন্তু এরপর দেনার দায়ে স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায়।

ওয়াল্ট ডিসনি অ্যানিমেশন স্টুডিওঃ মিকি মাউস এবং অন্যান্য চরিত্র

১৯২৩ সালে ডিসনি তাঁর ভাই রয় এবং কার্টুনিস্ট উব আইওয়ার্কেসর সঙ্গে হলিউডে যান এবং নতুন করে শুরু করেন ‘ডিসনি ব্রাদার্স’ কার্টুন স্টুডিও’। পরবর্তীকালে রয়ের পরামর্শ অনুযায়ীই এই স্টুডিয়োর নাম বদলে ‘ওয়াল্ট ডিসনি স্টুডিয়োস’ হয়। আগে তৈরি অ্যালিসের কার্টুন সম্প্রচারের জন্য ভাড়া দেওয়া ছাড়াও তাঁরা নতুন নতুন আরও কার্টুন চরিত্র তৈরি করতে লাগলেন। সেগুলির মধ্যে প্রথম জনপ্রিয় হল ‘অসওয়াল্ড নামের একটি ভাগ্যবান খরগোশ’। সেই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিগুলি একেকটি ১৫০০ ডলার করে চুক্তিবদ্ধ হল।
এরপরই তৈরি হল পৃথিবী বিখ্যাত, সকলের প্রিয় চরিত্র মিকি মাউস।

70 disney characters and the actors who voiced them 1pyc.1080
IGN India


১৯২৭ সাল, সবাক চলচ্চিত্র সদ্য তৈরি হতে শুরু করেছে। হলিউডে নির্মিত হচ্ছে বিখ্যাত সব নাটক আর নভেলের চলচ্চিত্র রূপ। যাকে বলে গুরু গম্ভীর আবহ; ঠিক তার মাঝখানে সদ্যজাত একমাত্র মৌলিক চরিত্র হিসেবে নজর কেড়ে নিল মিকি মাউসের দুষ্টু , হালকা, মজাদার প্রাণশক্তি। ১৯২৮ সালে কলোনি থিয়েটারে মানুষ আনন্দে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে দেখল ‘স্টিমবোট উইলি’ , মিকির প্রথম ছোট দৈর্ঘ্যের ছবি। মিকির সেই জনপ্রিয় মিষ্টি কন্ঠস্বর আসলে স্বয়ং ওয়াল্টের। সঙ্গে উপরি পাওনা ডিসনি স্টুডিয়োর থিম সুর যা আজও একইভাবে শুরুতে ব্যবহৃত হয়।
১৯২৯ সালে ‘সিলি সিম্ফনি’ তৈরি হলে মিকির বন্ধুদেরও পাওয়া গেল। মিন্নি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, গুফি এবং প্লুটোরাও মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গেল নিমেষে । এছাড়াও ডিসনি স্টুডিয়োর অন্যান্য জনপ্রিয় কার্টুনগুলির নাম না করলেই নয়, যেমন- ‘ ফ্লাওয়ারস অ্যান্ড ট্রিস’( ১৯৩২), যেটি একাডেমী পুরষ্কার প্রাপ্ত ডিসনির প্রথম রঙিন ছবি। ১৯৩৩ সালে ‘ দ্য থ্রি লিটল পিগস’ ছবির মুখ্য গানটি আমেরিকার অবসাদের ( The Great Depression) সময়ের থিম হয়ে উঠেছিল – ‘‘Who’s afraid of the Big Bad Wolf?’’

ওয়াল্ট ডিসনির পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র

SNOW WHITE THE SEVEN DWARFS 8390LB scaled
https://www.google.com/url?sa=i&url=https%3A%2F%2Foriginalvintagemovieposters.com%2Fsnow-white-and-the-seven-dwarfs-original-vintage-walt-disney-uk-release-movie-poster%2F&psig=AOvVaw3Kw985dFpTXRN33N-_3o3z&ust=1607232077356000&source=images&cd=vfe&ved=0CAMQjB1qFwoTCMjj66CMtu0CFQAAAAAdAAAAABAD

ওয়াল্ট ডিজনি কখনও বিশ্রাম নিতেন না। তিনি শর্টস ছাড়াও পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড ছবি তৈরির বিষয়ে দীর্ঘ সময় চিন্তা করেছিলেন। তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘ স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’(১৯৩৭) সমালোচক এবং শ্রোতাদের দ্বারা মজাদার এবং সংবেদনশীল রোম্যান্স হিসাবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। স্নো হোয়াইট, প্রিন্স এবং উইকেড কুইনের চরিত্রগুলিতে বিভিন্ন মানব চরিত্রকে দক্ষতার সঙ্গে অ্যানিমেটেড করেছে ডিসনি স্টুডিও। চরম খারাপ সময় এবং অবসাদের মধ্যেও এই ফিল্মটি দেড় লক্ষ্য ডলার লভ্যাঙ্ক তুলে আনে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য! কিন্তু এই সাফল্যই ওয়াল্ট ডিসনি স্টুডিওকে পরবর্তী একের পর এক কাজের মূলধন যোগায়। এ যেন মানবহৃদয়ের চিরন্তন শিশুদেরই জয়; যারা বিশ্বযুদ্ধের সংকটের মধ্যেও একের পর এক ডিসনি চরিত্রকে আপন করে নিতে পেরেছিল। সময়টা খেয়াল করলে আজও চমকে যেতে হয়।

b23fe3f5da6c29072ae11bcd2dbc7b1a

অন্যদিকে, ডিসনি ছোট প্রাণীদের নৃতাত্ত্বিক চরিত্র উপস্থাপন করার জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলিও চালিয়ে যেতে থাকেন। সেখান থেকেই থেকে পিনোচিও (১৯৪০), ডাম্বো (১৯৪১) এবং বাম্বি (১৯৪২) -র মতো বিভিন্ন ধরণের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের বিকাশ করেছিলেন। ডিজনি একটি নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছিল যার নাম ‘ফ্যান্টাসিয়া’(১৯৪০)। এরপরের দিকের বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলি আমরা সকলেই জানি, যেমন- Cinderella (1950)Treasure Island (1950)Alice in Wonderland (1951)Peter Pan (1953)Lady and the Tramp (1955)Sleeping Beauty (1959)101 Dalmatians (1961) প্রভৃতি।
ষাটের দশকের মধ্যে ডিসনি প্রায় ১০০টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। তৈরি করেছেন একাধিক সফল টেলিভিশন সিরিজও।


ডিসনিল্যান্ড

503ed9f650ce457dbc2ba9803ba51d4a
Getty

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের কাছে একটি বিশাল বিনোদন পার্ক নির্মাণ করেছিলেন ওয়াল্ট, যার নাম ‘ডিসনিল্যান্ড’। ছোট বড় সকলের অন্তর্নিহিত শৈশবের পরিতৃপ্তি ঘটবে এই পার্কে এসে, এমনটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। মৃত্যুর আগে তিনি ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কাছেও ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের মতো দ্বিতীয় একটি পার্ক নির্মাণ শুরু করেছিলেন। ওয়াল্টের একটি উক্তি তাঁর গোটা জীবনের কর্মকাণ্ডকে এসে মিলিয়ে দিয়েছে এই ডিসনিল্যান্ডে-

“Disneyland will never be completed. It will continue to grow as long as there is imagination left in the world. ‘’

আমাদের শিশুমনের চাহিদা কোনোদিন ফুরবেনা; অতএব সেই স্বপ্নের কারখানা চলতেই থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ঠিক যেমনটি ছিল ডিসনি নামক এক বিরাট শিশুর ইচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ